ঝড়ের সময়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যৌন হয়রানির শিকার হন নারীরা: গবেষণা

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিবছরই কয়েকবার আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যা আরও বাড়ছে। দুর্যোগের সময়ে প্রাণ বাঁচাতে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিতে হয় উপকূলবাসীদের। তবে সেখানে গোটা গ্রামের নারী-পুরুষদের একত্রে অবস্থান করতে হয়। আলাদা কোন টয়লেট ব্যবহারেরও উপায় থাকে না। এমনকি নারী ও কিশোরীরা বিভিন্ন সময়ে সময়ে যৌন হয়রানির শিকারও হন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে খুলনায় এক সেমিনারে গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়। জাগ্রতা যুব সংঘ (জেজেএস) ও জাপানের শাপলা নীড় এর সহযোগিতায় খুলনার সিএসএস আভা সেন্টারে 'নারী ও মেয়েদের দুর্যোগের ঝুঁকি'র ওপর এই আঞ্চলিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
এতে গবেষণার তথ্য উপস্থাপন করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক দলের প্রধান মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, "আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় নারী-পুরুষ একত্রে অবস্থান করায় সেখানে যৌন হয়রানির মত ঘটনাও ঘটেছে। নিরাপদ টয়লেট না থাকায়– নারী ও কিশোরীরা শারীরিক সমস্যায় পড়ে আরও অসুস্থ হয়েছেন। পাশাপাশি সাইক্লোন শেল্টারে যাতায়াতের ভালো রাস্তা না থাকায়— গর্ভবতী মহিলা, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য খুবই কষ্টকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যার কারণে দুর্যোগের সময় এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ব্যবহারে তারা নিরুৎসাহিত থাকে। বিশেষ করে, কিশোরী মেয়েদের জন্য সেখানে তার পরিবার নিরাপদ মনে করে না।"
গবেষণাটি করা হয়েছে সুন্দরবন-সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার সব থেকে বেশি দুর্যোগপ্রবণ এলাকা কয়রা সদর, দক্ষিণ ও উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নে। সেখানে ৩০০ জন নারী ও কিশোরী এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন।
গবেষক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কিশোরীরা আমাদের জানিয়েছেন, আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হলেও, তারা সামাজিকভাবে পরিবারের কাছে পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারেননি।
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন ওই অঞ্চলের আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মুন্ডা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বাসন্তি রানী মুন্ডা। তিনি বলেন, কোনো কিশোরী আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে অবস্থানের সময়ে যদি তার পিরিয়ড চলতে থাকে–- তবে সেখানে নিরাপদ টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ না থাকায়— ওই কিশোরী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। বয়স্ক মহিলারাও একই অসুবিধায় পড়েন। যার কারণে আশ্রয়কেন্দ্রকে মহিলারা নিরাপদ মনে করেন না।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন জেজেএস এর নির্বাহী পরিচালক এটিএম জাকির হোসেন। তিনি বলেন, স্থানীয়দের পরামর্শে আমরা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করি। তাতে ঝড়ের সময়ে নারী ও কিশোরীদের ঝুঁকির বিষয়গুলি উঠে এসেছে। পাশাপশি, আর্থ-সামাজিক নানান সীমাবদ্ধতা কয়রা উপজেলার পরিবারগুলোর মধ্যে দুর্যোগের ঝুঁকিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের গবেষণা সেই বিষয়টিও উঠে এসেছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাদিয়া আফরিন। তিনি বলেন, এসব সীমাবদ্ধতা থেকে নারীরা এখনো বের হতে পারিনি। যদিও আগের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, তবে প্রতিবন্ধকতাও কম নয়। ঝড়ের সময়ে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় তারা যেসব সমস্যায় সম্মুখীন হচ্ছেন, ভবিষ্যতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ে এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনের জন্য গবেষক দলের প্রধান মো. মোস্তাফিজুর রহমান কয়েকটি প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, জেন্ডার সংবেদনশীল অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে নারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে আলাদা স্থান, নিরাপদ ল্যাট্রিন এবং পর্যাপ্ত আলোর সুবিধাসহ সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গর্ভবতী মহিলা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মতো দুর্বল গোষ্ঠীগুলোর জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের সাথে সড়ক যোগাযোগ উন্নত করতে হবে। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের নকশা তৈরী এবং রক্ষণাবেক্ষণে নারী-নেতৃত্বাধীন কমিটিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আলোচনায় আরোও অংশ নেন শাপলা নীরের সিনিয়র প্রতিনিধিরা, যার মধ্যে ছিলেন মহাসচিব এমিকো ফুজিওকা, হিরোমি কাতসুই, তোমোকো উচিয়ামা ও মো. আনিছুজ্জামান। প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন, মোস্তফা জামাল পপলু । কমিউনিটির পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নেন বাসন্তী রানী মুন্ডা, শেখ সোহরাব হোসেন এবং মোঃ লুৎফর রহমান সরদার। এতে সরকারি কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম ও শিক্ষাবিদসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনরা উপস্থিত ছিলেন।