৩০ কোটি টাকার রোড সুইপার অকার্যকর, এখন সিটি করপোরেশনগুলোর ‘গলার কাঁটা’

নগর পরিচ্ছন্নতায় আধুনিকতা আনতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় (এলজিআরডি) ১২টি সিটি করপোরেশনকে ৩০ কোটি টাকা মূল্যের ২০টি রোড সুইপার হস্তান্তর করে। কিন্তু এখন এই রোড সুইপারগুলো উল্টো সিটি করপোরেশনগুলোর জন্য বাড়তি বোঝায় পরিণত হয়েছে।
কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা এই ক্রয় প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে বলেছেন যে, এই সুইপারগুলো এদেশের পরিবেশের অনুপযোগী এবং অকার্যকর।
সিটি করপোরেশনগুলো জানিয়েছে, এসব যন্ত্র সঠিকভাবে রাস্তা পরিষ্কার করতে পারছে না। বরং বাতাসে ধুলো-বালি উড়িয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে। পাশাপাশি এই বাহনগুলো বিপুল পরিমাণ জ্বালানি খরচ করে, যা পরিচালন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সিটি করপোরেশনগুলোর তথ্যমতে, বেশিরভাগ রোড সুইপার ব্যবহারই অসুবিধাজনক এবং ব্যবহার প্রায় হয় না বললেই চলে। তাদের দাবি, ম্যানুয়াল পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা এখনও যান্ত্রিক পদ্ধতির চেয়ে বেশি কার্যকর ও সাশ্রয়ী।
ইতালি থেকে আমদানি করা প্রতিটি রোড সুইপারের দাম পড়েছে প্রায় ১.৫ কোটি টাকা। এলজিআরডি মন্ত্রণালয় বলছে, এই গাড়িতে উন্নত জাপানি প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এর দাম এত বেশি পড়েছে।
২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ২০টি রোড সুইপার বিতরণ করেন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পেয়েছিল তিনটি করে সুইপার; নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর পেয়েছিল দুটি করে। বাকি সিটি করপোরেশনগুলো পেয়েছিল একটি করে সুইপার।
কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি গাড়ি দিনে প্রায় ১২ কিলোমিটার রাস্তা পরিষ্কার করতে সক্ষম। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রমিকদের দাবি, প্রতিদিন সড়কে জমা হওয়া ধুলো সামলানোর জন্য সুইপারের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। এছাড়া ধুলো ও আবর্জনার সংমিশ্রণে যন্ত্রগুলো স্বল্প সময় ব্যবহারের পরই অকেজো হয়ে পড়ে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিগত সরকারের আমলে এসব যন্ত্রপাতি কেনাই হতো যাতে বড় অঙ্কের দুর্নীতি করা যায়। আর এসব প্রকল্পের কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করেই বিভিন্ন দেশ থেকে ২-৩গুণ দামে এসব সরঞ্জাম আমদানি করতো।
'রোড সুইপারের এসব যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশের সাথে মানানসই না, সেটা জেনেই রাষ্ট্রের টাকা নষ্ট করা হয়েছে।'
স্থানীয় সরকার বিভাগের (সিটি করপোরেশন-১) উপসচিব মাহবুবা আইরিন বলেন, '২০২০ সালে আমি এই বিভাগে ছিলাম না। রোড সুইপার প্রতি বছরই কিছু না কিছু কেনা হয়। সেগুলো কাজ করছে কি না, সেটা আমার জানা নেই। এই সম্পর্কে আমার কোনো আইডিয়া নেই, দেখে পরে জানাতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এসব ইকুইপমেন্ট কেনার আগেই যাচাই-বাছাই করে কেনার কথা। আমার মনে হয় না ব্যবহার-উপযোগী নয়, এমনটা হওয়ার কথা না।'
সিটি করপোরেশন কর্মকর্তাদের হতাশা
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিকে এলজিআরডি মন্ত্রণালয় থেকে সরবরাহ করা ছয়টি ভ্যাকুয়াম রোড সুইপার এখন সিটি করপোরেশনগুলোর জন্য একপ্রকার অপচয়ে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি টিবিএসের একজন প্রতিবেদক নগর কর্তৃপক্ষের গ্যারেজ পরিদর্শন করে দেখেন, আধুনিক এই রোড সুইপারগুলো অব্যবহৃত পড়ে আছে, ধুলোর আস্তর পড়ে গেছে।
ওয়ার্কশপে বাহনগুলো পরিদর্শনের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা জানান, যন্ত্রগুলো প্রথম দিকে ব্যবহার করা হলেও কয়েকদিন যেতে না যেতেই সমস্যা দেখা দেয়। ভারী ময়লা পরিষ্কারে অক্ষম হওয়ায় ভ্যাকুয়াম পাইপগুলো মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে যন্ত্রগুলোর ব্যবহার কমতে থাকে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ফিদা হাসান বলেন, 'স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে যে তিনটি রোড সুইপার আমাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো কার্যকরী নয়। এগুলো একদিকে আমাদের দেশের পরিবেশের সাথে একদমই মানানসই নয়, আবার এগুলো ব্যবহার করলে উল্টো রাস্তার ধূলা বাতাসের সাথে মিশে যায়। এই তিনটি যানবাহন উল্টো আমাদের জন্য গলার কাঁটা।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, 'এই যন্ত্রগুলোতে শুরু থেকেই টেকনিক্যালি কিছু দুর্বলতা ছিলো। আমাদের কাজে এগুলো কোনো কার্যকরী সাপোর্ট দিচ্ছে না বলে আর ব্যবহার করছি না। এর থেকে ম্যানুয়ালি পরিচ্ছন্ন কর্মীদের দিয়ে করালে কাজ দ্রুত ও কম খরচে হয়।'
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান কনজারভেন্সি কর্মকর্তা লতিফুল হক কাজমী বলেন, 'এই যন্ত্রগুলো খুব একটা কাজে আসে না। একটি গাড়ির এক ঘণ্টায় ৭ লিটার অকটেন দরকার। এর পেছনে যে পরিমাণ তেল যায়, সেটা আমাদের জন্য ব্যয় সাশ্রয়ী না। তাই এগুলো অব্যবহৃত অবস্থায়ই পড়ে আছে।'
সিলেট সিটি করপোরেশনে ২০২০ সালের আগে কোনো ভ্যাকুয়াম রোড সুইপার ব্যবহার করেনি। তাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে একটি রোড সুইপার পেয়ে ভেবেছিল, তাদের রাস্তা ঝাড়ুর বিষয়টি অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু যন্ত্রটি তাদের জন্য উল্টো ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সিলেট সিটি করপোরেশন শুরুর দিকে কিছুদিন যন্ত্রটি ব্যবহার করেছিল প্রশস্ত সড়কগুলোতে। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই দেখা দেয় যান্ত্রিক ত্রুটি। নিয়মিতই লাগতে থাকে বিভন্ন যন্ত্রাংশ। কয়েক মাস ব্যবহারের পরেই দেখতে পান রাস্তার ধূলা ওপর দিয়ে আবার বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে জ্বালানির প্রয়োজনও বাড়তে থাকে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ একলিম আবদীন টিবিএসকে বলেন, 'এখন আমরা এই যন্ত্রটি বছরে মাত্র কয়েকবার ব্যতীত একদমই ব্যবহার করছি না। যন্ত্রটি শীতকালে ব্যবহারের উপযোগী, কিন্তু এটি ব্যবহারে উল্টো বাতাসে ধূলা ছড়িয়ে দেয়। আর এটি ব্যবহার করার মতো রাস্তাও আমাদের তেমন নেই। এটি মূলত শীতপ্রধান দেশের যন্ত্র—এবং অতিরিক্ত বর্জ্য থাকলে এটি চালানো যায় না।'
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাইনউদ্দিন চিশতী বলেন, 'আমরা প্রথম প্রথম ব্যবহার করতাম, কিন্তু এটি ব্যবহার করার মতো রাস্তা কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে নেই। এই যন্ত্র ব্যবহার করতে হলে আগে রাস্তা উন্নত দেশের মতো করতে হবে, এরপর এর ব্যবহার। আর বর্ষাকালে এই গাড়ি রাস্তায় নামানোরই সুযোগ নেই।'
খুলনা সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল) মো. আবদুল আজিজ বলেন, 'আমরা এই গাড়িটি নিয়মিত ব্যবহার করতে পারছি না। যখন কোনো বিশেষ দিবস কিংবা সরকারের শীর্ষস্থানীয় কেউ খুলনায় আসেন, তখন এই যন্ত্রটি আমাদের বড় রাস্তা পরিষ্কার করতে ব্যবহার করি রাতে। তবে আমরা এই গাড়িটি দিয়ে ঝাড়ুর চেয়ে পানি দেওয়াতে বেশি ব্যবহার করি। এ ধরনের যন্ত্র আমাদের রাস্তায় ব্যবহার করা যায় না, কারণ রাস্তা মসৃণ নয়।'
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান বলেন, 'কোটি টাকার এই যন্ত্র ব্যবহার করলে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। কারণ এটি ব্যবহার করলে বাতাসে ধূলা উড়ে। তাই বিশেষ দিনে রাতে ব্যবহার করা হয়। আমাদের সিটি করপোরেশনের জন্য এটি মোটেও ব্যবহারোপযোগী নয়।'
এলজিআরডি মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সবগুলো সিটি করপোরেশনে এই যন্ত্র সরবরাহের কথা বলা হলেও বরিশাল সিটি করপোরেশন এখনও রোড সুইপারটি পায়নি।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সহকারী পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী টিবিএসকে বলেন, 'আমরা কোনো রোড সুইপার পাইনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে। ২০২০ সালে সিটি করপোরেশনগুলোকে যে রোড সুইপার দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বরিশাল সিটি করপোরেশনকে একটি দেওয়ার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা হাতে পাইনি।' পুরনো একটি রোড সুইপার মাঝে মাঝে ব্যবহার হয় বলে জানান এ কর্মকর্তা।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা যান্ত্রিক সরঞ্জাম কেনার সময় নিজস্ব স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে বলেন, আওয়ামী লীগ প্রায়ই ব্যয়বহুল বিদেশি যন্ত্র আমদানির পথে হেঁটেছে, আর্থিকভাবে সংশ্লিষ্টদের লাভবান করেছে।
সেন্টার অফ অ্যটমোস্ফিয়ারিক পলিউশন স্টাডিজ-এর চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'বায়ুদূষণ কিংবা যেকোনো সমস্যা নিয়ে যখন আমরা কোনো সুপারিশ করি, তখন দেখতে পাই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা থেকে প্রকল্প নেওয়া হয় এবং যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, যানবাহন কেনা হয়। এতে শুধুই জনগণের টাকা নষ্ট হয় এবং মাঝ দিয়ে এর সাথে জড়িতরা লুটপাট করে নেন। আসলে কোনো সমাধান আদৌ হয় না।
'রোড সুইপারগুলো কেনাও এমন একটি ঘটনা। যে যন্ত্রগুলো কেনা হয়েছিলো, সেগুলো দূষণ রোধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এসব যন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাদেশের সাথে মানানসই, এমন কিছু নিয়েই চিন্তা করা প্রয়োজন।'
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অভ প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, 'সরকারের সংস্থাগুলোর যেকোনো উদ্যোগ হওয়া উচিত সাশ্রয়ী ও বাংলাদেশের কন্ডিশনের উপযোগী। বিগত আওয়ামী সরকার এমন অপ্রয়োজনীয় ও অকার্যকর প্রকল্পের মাধ্যমে লুটপাট করেছে।
'এসব কাজে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানিনির্ভরতা বাদ দিয়ে দেশীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাধান খুজতে হবে। পাশাপাশি সরকারের অবশ্যই টেকসই বন্দোবস্ত করতে হবে।'