ঈদ উপলক্ষ্যে ঢাকায় ১৭ অস্থায়ী পশুর হাট ইজারা: কার ঝুলিতে সবচেয়ে বেশি?

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ১৭টি অস্থায়ী পশুর হাট ইজারা দিয়েছে। তবে এই ইজারা ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, কারণ অধিকাংশ হাট বিএনপি-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছে গেছে। গত বছরের আওয়ামী লীগপন্থী ইজারাদারদের সরিয়ে এ বছর নতুনদের জায়গা দেওয়া হয়েছে।
দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, এবার ঢাকায় মোট ২০টি পশুর হাট বসবে—ঢাকা দক্ষিণে ৮টি ও উত্তরে ১২টি। এর মধ্যে ১৭টির দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। বাকি ৩টি হাটের ইজারা এক-দুদিনের মধ্যেই দেওয়া হবে। এ ছাড়া গাবতলী (উত্তর সিটি) ও সারুলিয়া (দক্ষিণ সিটি) এলাকায় দুটি স্থায়ী পশুর হাটও বসবে।
চলতি বছর ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হবে ৭ জুন। অস্থায়ী হাটগুলো চালু হবে ৩ জুন, ঈদের চার দিন আগে। যদিও ঈদের দিন পর্যন্ত পশু কেনা-বেচা চলে।
প্রস্তুতি সম্পর্কে ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা ৯টি অস্থায়ী হাটের ইজারা সম্পন্ন করেছি। আজ রাত (রবিবার) হাটগুলোর প্রস্তুতি, রাস্তাঘাটের জরুরি সংস্কারের বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করবো। রাজধানীবাসী যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে কুরবানির পশু কেনাকাটা এবং তা সম্পন্ন করতে পারে, সেই লক্ষ্যে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাঠে থাকবেন। হাটগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে কোথাও কোনো ব্যত্যয় পেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিবো।'
ঢাকা উত্তরের ৯টির মধ্যে ৮টি কোরবানির হাট বিএনপির হাতে
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী ১২টি কোরবানির হাটের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৯টির ইজারা চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৮টিই বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। স্থায়ী গাবতলী হাটও ঈদসহ এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা উত্তরের সবচেয়ে বড় অস্থায়ী হাটটি বসবে উত্তরার দিয়াবাড়িতে, সেক্টর ১৬ ও ১৮-এর পাশে। ১০ কোটি ১ লাখ টাকায় এটি ইজারা নিয়েছে 'এসএ ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ'। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক শমসের আলী খোকন বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক।
গতকাল টিবিএস-কে শমসের বলেন, 'আমরা এখনও হাটের কার্যক্রম শুরু করতে পারিনি। আজকে (রবিবার) কেবল পে অর্ডার পেলাম। এতো অল্প সময়ের মধ্যে হাট প্রস্তুত করা চ্যালেঞ্জিং, এরপরেও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।'
মোহাম্মদপুরের বসিলা হাটটি ২ কোটি ৭১ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছে 'মেসার্স আহাদ এন্টারপ্রাইজ'। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. জালাল মৃধা মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক।
মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গায় হাটের ইজারা পেয়েছে সোহাগ এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক রতন মিয়া পেশায় ব্যবসায়ী হলেও স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সহায়তায় তিনি এই বাজারের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
উত্তরা-১০ নম্বর সেক্টর রানাভোলা অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন খালি জায়গার হাটের ইজারা পেয়েছে আতিকুর রহমান অ্যান্ড কোং। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আতিকুর রহমান মহানগর উত্তর বিএনপি সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
তেজগাঁওয়ের ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পাশের একটি হাটের ইজারা পেয়েছে জায়ান এন্টারপ্রাইজ। ২ কোটি ১৭ লাখ টাকায় এই হাটের ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা যুবদলের সদস্যসচিব।
খিলক্ষেত থানাধীন মস্তুল চেকপোস্ট সংলগ্ন খালি জায়গার হাটটি ১ কোটি ৫১ লাখ ৯,৫০০ টাকায় ইজারা পেয়েছে সুরমি এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মজিবুল্লা খন্দকারও বিএনপির নেতা। এ হাটটি ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আকতার হোসাইন নেপথ্যে থেকে পরিচালনা করছেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ টিবিএস-কে বলেন, 'আমরা কাঙ্ক্ষিত দর না পাওয়ায় রিটেন্ডার করেছি এবং পরের বার দর বেড়েছে। আমরা চেয়েছিলাম রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বাহিরেও হাটগুলোর ইজারা পাক। কিন্তু সর্বোচ্চ দরের কারণে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতারাই ইজারা পেয়েছেন।'
ঢাকা উত্তরের একমাত্র স্থায়ী গাবতলীর পশুর হাটটি ইজারার জন্য সর্বোচ্চ ২৫ কোটি টাকা দর পাওয়া গেলেও, এই হাটের ইজারা পেয়েছে ২য় সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান এরফান ট্রেডার্স। তারা ১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকায় এই হাটটি এক বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে। এরফান ট্রেডার্স এর মালিক দারুস সালাম থানা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক (সাজু)।
মোহাম্মদ এজাজ বলেন, 'সর্বোচ্চ দরদাতা টাকা জমা দিয়েও আবার অনাস্থা জ্ঞাপন করলে, আমরা নিয়ম অনুযায়ী ২য় সর্বোচ্চ দরদাতাকে দিতে বাধ্য হই।'
ঢাকা উত্তর সিটির অধীনে থাকা ৯টি অস্থায়ী পশুর হাট থেকে মোট ২৫ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার টাকার রাজস্ব আদায় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ঢাকা উত্তর সিটির এস্টেট কর্মকর্তা ফারজানা খানম বলেন, 'বাকি তিনটি হাটের ইজারা প্রক্রিয়া সোমবার চূড়ান্ত করার চেষ্টা করব। আমরা সর্বোচ্চ দরদাতাদেরকেই ইজারা দিয়েছি। কেউ যদি আরও বেশি দর দিত, তাহলে নিয়ম অনুযায়ী তাকেই ইজারা দেওয়া হতো।'
দক্ষিণের কোরবানির হাটে নিয়ন্ত্রণ বিএনপির, কিছু ইজারা মিলেছে অর্ধেকেরও কম দামে
গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী কোরবানির হাটের ইজারা ছিল আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের দখলে। তবে এবার সব হাটই নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বিএনপি-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ উঠেছে, এর মধ্যে অন্তত দুটি হাট ইজারা দেওয়া হয়েছে সরকারি নির্ধারিত দামের অর্ধেকেরও কম মূল্যে।
দক্ষিণ সিটির নারিন্দায় সাদেক হোসেন খোকা মাঠের দক্ষিণ পাশে ও ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালে দুটি হাটের সরকারি মূল্য ছিল ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বেশি। অথচ সেগুলো মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে বিএনপি-ঘনিষ্ঠ সৈয়দ মাসুদ রেজার কাছে। তিনি প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার গোপীবাগের বাসভবনের দেখভাল করেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা।
এ বিষয়ে মাসুদ রেজা বলেন, 'আমি নিয়ম মেনেই ইজারা পেয়েছি। এখানে রাজনৈতিক পরিচয়ের কোনো বিষয় ছিল না।'
অদূরেই ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব মাঠে একটি হাটের সরকারি মূল্য ধরা হয়েছিল ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সেটিও মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় ইজারা পেয়েছেন বিএনপি-সমর্থিত সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন।
এছাড়া ডেমরার আমুলিয়া আলীগড় মডেল কলেজের উত্তর পাশের খালি জায়গায় স্থাপিত অস্থায়ী হাটের ইজারা পেয়েছেন জয়নাল আবেদীন (রতন)। তিনি ডেমরা থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি। গত বছর এ হাটের ইজারা পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের এস এম নেওয়াজ সোহাগ।
পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পশ্চিম পাশে নদীর পাড়ে খালি জায়গায় এবার পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মুহাম্মদ আলী। নেপথ্যে রয়েছেন ওই এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদের বড় ছেলে ও স্থানীয় বিএনপির নেতা–কর্মীরা। গত বছর এ হাটের ইজারা পেয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মইন উদ্দিন চিশতী।
লালবাগের পোস্তা এলাকায় রহমতগঞ্জ ক্লাবের খালি জায়গায় এবার কোরবানির পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটির সভাপতি টিপু সুলতান। তিনি চকবাজার থানা বিএনপির সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। গত বছর হাটটির ইজারা পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সোলায়মান সেলিম।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আটটি অস্থায়ী পশুর হাট থেকে এ বছর আয় হচ্ছে ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ২৫ হাজার ৭৭২ টাকা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এস্টেট কর্মকর্তা হাসিবা খান টিবিএস-কে বলেন, 'নগর ভবনে তালা থাকায় আমরা সচিবালয় থেকেই জরুরি দায়িত্ব হিসেবে একটি হাটের ইজারা সম্পন্ন করেছি। আমাদের ১১টি হাটের মধ্যে ছয়টির ইজারা চূড়ান্ত হয়েছে। দুটির দর খুবই কম আসায় তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। একটি হাটে কোনো দরপত্র জমা পড়েনি। আর দুটি হাট স্থাপনে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'দুটি হাটে সরকার নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেকেরও কম দরে ইজারা দেওয়া হয়েছে, কারণ তার চেয়ে বেশি দর আমরা পাইনি। এখন সেগুলো অনুমোদন দেবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়। আমাদের পক্ষ থেকে বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই।'