মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ব্যয় ১ হাজার কোটি থাকা হলেও বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ
গত ১০ বছরে মশা নিধন কর্মসূচি ও কীটনাশক কেনায় ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর—এই দুই সিটি কর্পোরেশন মোট ১,০১২ কোটি টাকা ব্যয় করলেও, চলতি বছরেও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যায় দেশব্যাপী শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা।
চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গুতে ৩৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ২১৩ জনই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার বাসিন্দা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবছর বিপুল ব্যয় সত্ত্বেও কার্যকরভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। তাদের মতে, পুরোনো পদ্ধতিতে কীটনাশক প্রয়োগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা এবং ডেঙ্গু রোগীদের পর্যাপ্ত সেবার ব্যবস্থা না থাকাই প্রতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঠেলে দিয়েছে।
তবে দুই সিটি কর্পোরেশনের দাবি, আগের বছরের তুলনায় এবার রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসার জন্য তারা জনগণের উদাসীনতা, সচেতনতার অভাব এবং জনবলের তীব্র সংকটকে দায়ী করছেন।
তারা আরও অভিযোগ করে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিভ্রান্তিকর, কারণ ঢাকার বাইরে থেকে আসা বহু রোগীকেও ঢাকার রোগী হিসেবে গণনা করা হয়। ফলে প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় ঢাকার রোগীর পরিসংখ্যান বেশি দেখায়।
কোটি কোটি টাকা কোথায় গেল?
বার্ষিক বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করেছে ৬৮৮.৩৯ কোটি টাকা, আর ঢাকা দক্ষিণ ব্যয় করেছে ৩২৩.৬৩ কোটি টাকা।
এই বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ ব্যয় হয়েছে কীটনাশক কেনার পেছনে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৮৭.৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, যার মধ্যে ৮০ কোটি টাকা শুধু কীটনাশক কেনায় ব্যয় হবে। আরও ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য।
অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ রেখেছে ৫৩.৫০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৪৫ কোটি টাকা শুধু কীটনাশক কেনায় ব্যয় হবে।
সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের কীটনাশক এবং যন্ত্রপাতি কেনা প্রায় শেষ হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় অনুমোদিত বাজেটের চেয়েও বেশি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অন্য কোনো সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার মতো ব্যয় করে না—তবুও ঢাকার বাসিন্দারা তার সুফল পাচ্ছেন না। রাজধানীতে ডেঙ্গু সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নভেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে সারাদেশে ডেঙ্গুতে ৫৩ জন মারা গেছেন, যার মধ্যে ৩৮ জন ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দা। একই সময়ে সারাদেশে ৮৩,৮৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যার মধ্যে ২৪,৮৮০ জন ঢাকার বাসিন্দা।
'সমস্যার মূল হলো গভর্ন্যান্সের ব্যর্থতা'
এন্টোমোলজিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দেশের সমস্যার মূল হলো গভর্ন্যান্সের ঘাটতি। মশক নিয়ন্ত্রণের বাজেট মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে ব্যয় হয় না। একদিকে মশার কীটনাশক কেনাকাটায় দুর্নীতি, অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে আউটসোর্সিং এ যেভাবে কাজ করানোর কথা সেটা হচ্ছে না। সমন্বিত মশক নিধনে না গেলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমানো সম্ভব নয়।'
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ আরও বলেন, কর্তৃপক্ষকে বহুবার 'ভেক্টর-কন্ট্রোল' পদ্ধতি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হলেও তা উপেক্ষিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'সরকারি সংস্থাগুলো বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে নিজেদের সুবিধামতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারও একই পথে চলছে। আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। দুর্নীতি ও অনিয়ম আগের মতোই চলছে। এগুলো না বদলালে ডেঙ্গু কেন, কোনো কিছুতেই উন্নতি হবে না।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে সিটি কর্পোরেশন
ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুসংক্রান্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যকে বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেছে।
তারা বলেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হিসাব হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়। ফলে, ওই দুটি সিটি কর্পোরেশনের অধীনে থাকা হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া সকল রোগীকে ঢাকার রোগী হিসেবে গণ্য করা হয়। বাস্তবে, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের বাসিন্দা রোগীর সংখ্যা অনেক কম।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ বছর ঢাকার দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। ৯ নভেম্বর পর্যন্ত আমাদের এলাকায় ২৮ জনের মৃত্যু এবং প্রায় ৭০০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী রোগীর ঠিকানায় গিয়ে রোগী খুজে পাই না।'
তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন, ৫ নভেম্বর স্বাস্থ অধিদপ্তর সারাদেশে ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল, যার মধ্যে ৫ জনকে ঢাকার দক্ষিণের বাসিন্দা দেখানো হয়েছিল। নিশাত পারভিন বলেন, 'তবে যাচাই করার পর দেখা গেল, শুধু একজনই জুরাইনের বাসিন্দা। আরেকজন কিডনি সমস্যার কারণে মারা গেছেন, ডেঙ্গু নয়; এবং বাকি চারজন ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন।'
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল-আল-কায়েস টিবিএসকে বলেন, 'ঢাকা উত্তরে আমরা এবার প্রথমবারের মতো কেইস সার্ভেইল্যান্স [তথ্য পর্যবেক্ষণ] করছি। আমাদের ১৫টি হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে সপ্তাহে ২-৩ বার ডেঙ্গু তথ্য সংগ্রহ করি। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় থাকা রোগীর মাত্র ২৮ শতাংশ প্রকৃতপক্ষে আমাদের এলাকার বাসিন্দা। তাদের তথ্যে বড় ধরনের গরমিল আছে।'
তিনি বলেন, 'আমরা শনাক্ত হওয়া রোগীদের বাড়ির আশপাশে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। কিন্তু যখন ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীকে ঢাকার উত্তরের বাসিন্দা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়, তখন ঐ এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে খুব সামান্য কাজ হয়। ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে অন্তত ৪০ শতাংশ রোগী ঢাকার বাইরে থেকে আসেন—যেমন গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ বা সাভার।'
তিনি জানান, ঢাকা উত্তরে ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ব্র্যাকের সহযোগিতায় প্লাস্টিকের বোতল, টায়ার, ভাঙা আসবাবসহ কয়েকশত টন সম্ভাব্য এডিস প্রজনন স্থান অপসারণ করা হয়েছে। ইমরুল-আল-কায়েস বললেন, 'ভবনের মধ্যবর্তী ফাঁক, বারান্দা বা পার্কিং এলাকায় জমে থাকা পানি এখনো আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।'
তিনি আরও বলেন, 'নাগরিকরা সহযোগিতা করলে ঢাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কাছে নিয়ে আসা সম্ভব।'
দ্বিগুণ কীটনাশক প্রয়োগ
১১ জুন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন জরুরি সভা করে ঘোষণা দেয়, 'ফগিং মেশিনে' ব্যবহৃত কীটনাশকের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হবে—৩০ লিটার থেকে ৬০ লিটার—যাতে 'তাৎক্ষণিক ফল' পাওয়া যায়।
কিন্তু পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও, এটি এখনো দেশেতে ডেঙ্গু মৃত্যুর তালিকার শীর্ষে রয়েছে।
৬ নভেম্বর, সিটি কর্পোরেশন আবারও জরুরি সভা আহ্বান করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়, এ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড সঠিকভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে নাগরিকদের অংশগ্রহণে ওয়ার্ডভিত্তিক তদারকি টিম গঠন করা হবে। ডেঙ্গু সংক্রমণের তথ্য অনুযায়ী হটস্পট চিহ্নিত করা হবে এবং তারপরে লক্ষ্যভিত্তিক অভিযান পরিচালনা করা হবে।
তবে, এই ব্যবস্থাগুলো নেওয়ার পরও তেমন উন্নতি দেখা যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ডেঙ্গুতে মৃত ৩৮ জনের মধ্যে ২২ জন ঢাকা দক্ষিণে মারা গেছেন। সারাদেশে ৩৩১ জনের মধ্যে ১৫৬ জন ঢাকা দক্ষিণের।
ঢাকা দক্ষিণের প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, 'এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ একটি যৌথ দায়িত্ব। সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা যেমন দায়িত্ব পালন করবে, তেমনি নাগরিকদেরও সচেতন হয়ে দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতে হবে।'
গত সপ্তাহে ঢাকা উত্তরও জরুরি সভা করেছে। সভায় প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, 'বর্ষা মৌসুমের আগে আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেছি এবং পুরো বছর তাদের পরামর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। তবুও, ডেঙ্গুতে কেবল একজন মারা গেলেও সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। সীমিত জনবল থাকা সত্ত্বেও আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।'
জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রতি ১,০০০ জনে ২.৩ জন জনস্বাস্থ্য কর্মীর প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের এখানে প্রতি ১১,০০০ জনে রয়েছে মাত্র ১ জন। মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম শক্তিশালী করতে সিটি কর্পোরেশন সাতজন নতুন পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েছে।'
