এ বছর ডেঙ্গুতে মৃতদের অর্ধেকই তরুণ
চলতি বছরে ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত ৩০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, আর আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৭৭,০০০। উদ্বেগজনকভাবে, ডেঙ্গুতে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৫৩ শতাংশই তরুণ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগে এত মানুষের মৃত্যু 'জাতির জন্য লজ্জা'র বিষয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস)–এর তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণকারীদের ৫৩ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে, আর ১৫ শতাংশ হলো শিশু।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির পেছনে তিনটি মূল কারণ রয়েছে—জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়মিত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং জনসচেতনতার অভাব। তাদের মতে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে টেকসই ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
শনিবার (৮ নভেম্বর) সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৯৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যদিও এ সময়ে নতুন কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, "ডেঙ্গু প্রতিরোধের মূল উপায় হলো মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। আমরা এক টন ময়লা সরাচ্ছি, কিন্তু দশ টন নতুন করে জমছে। নিয়মিত এ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যথেষ্ট নয়—আমাদের হাজারো স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে দেশব্যাপী পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের টানা বৃষ্টিপাত এডিস মশার প্রজননের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, "বৃষ্টি থেমে গেলেও ডেঙ্গু অন্তত আরও দুই মাস চলবে—প্রথম মাসে সংক্রমণ বাড়বে, পরের মাসে ধীরে ধীরে কমবে।"
তার পূর্বাভাস অনুযায়ী, প্রাদুর্ভাব চলতে পারে জানুয়ারির মাঝামারি পর্যন্ত।
ডা. মুশতাক আরও বলেন, "ডেঙ্গু প্রতিরোধযোগ্য রোগ, তবুও মানুষ মারা যাচ্ছে—এটি লজ্জাজনক। আমাদের প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা আছে, কিন্তু সমন্বিতভাবে কাজ না করার কারণেই মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) জানিয়েছে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল ডেঙ্গু শক সিনড্রোম, এর পরের অবস্থানে ছিল এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, "জেলা ও সিটি পর্যায়ে দরিদ্র রোগীদের জন্য হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা নিশ্চিত করা জরুরি, বিশেষ করে বড় হাসপাতালগুলোতে যখন বেড খালি থাকে না।"
তিনি আরও বলেন, "যেসব রোগীর মশারি কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের হাসপাতালের ভেতর মশারির নিচে রাখলে সংক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।"
তিনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একযোগে তিনটি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান—মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা, আক্রান্ত রোগীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং পরিবেশ যেন মশার বংশবিস্তারে অনুকূল না হয় তা নিশ্চিত করা।
মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম
এডিস মশা দমনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বৃহস্পতিবার এক জরুরি সভার আয়োজন করে।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড ওষুধের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে স্থানীয় নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে ওয়ার্ডভিত্তিক তদারকি টিম গঠন করা হবে। এই টিম স্থানীয়ভাবে ওষুধ প্রয়োগের সময়সূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের তদারকি করবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে এবারে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কম। আমরা ব্যয়বহুল নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছি।"
তিনি বলেন, "স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ডেঙ্গু রোগীর যে তালিকা দিচ্ছে, সেটি পুরোপুরি সঠিক নয়। এখন পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ৭০০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আমরা তালিকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে মশা নিধন কার্যক্রম চালাই।"
ডা. নিশাত পারভীন আরও বলেন, "ডেঙ্গু মৌসুমে পুরোপুরি ডেঙ্গুমুক্ত থাকা সম্ভব নয়। এখন কিছু এলাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে, সেখানে বিশেষ অভিযান চলছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং ধারাবাহিক কার্যক্রমের ফলে ধীরে ধীরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসবে।"
এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, তাদের এলাকাতেও এডিস মশার উপদ্রব গত বছরের তুলনায় কমেছে। তারা বিটিআই ওষুধ প্রয়োগের পাশাপাশি হটস্পট চিহ্নিত করে বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, "এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে আমরা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সভা করেছি। সেখানে বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো সারা বছর ধরে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি।"
তিনি বলেন, "সাম্প্রতিক তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিগত বছরের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমেছে। তবে ডেঙ্গুতে একটি মৃত্যুও আমাদের কাম্য নয়। স্বল্প জনবল নিয়েও আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।"
জনবল সংকটের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রতি হাজারে ২.৩ জন কর্মী থাকা প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের রয়েছে প্রতি ১১ হাজারে একজন কর্মী—যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল।"
মৃত্যুহার কমাতে তিনি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করা এবং ডেঙ্গু পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "জ্বর দেখা দিলেই সরকারি উদ্যোগে বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে ডেঙ্গু পরীক্ষা নিশ্চিত করা উচিত। দ্রুত শনাক্তকরণে মানুষ সময়মতো সতর্ক হতে পারবে।"
তিনি বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধি, সহজলভ্য পরীক্ষা ব্যবস্থা এবং দরিদ্র রোগীদের জন্য চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. মো. আবু জাফর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ডেঙ্গু মোকাবিলায় মশা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জ্বর দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগীরা দেরিতে এলে আমাদের করার তেমন কিছু থাকে না।"
তিনি আরও জানান, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত স্যালাইন মজুত রাখা হচ্ছে এবং এনএস–১ টেস্ট বিনামূল্যে করা হচ্ছে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, "মানুষ যদি দায়িত্বশীল না হয়, তবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।"
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় ৯৯৩ জন এবং সারাদেশে ২,৭৪০ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
