উপযুক্ত ভ্যাকসিনের অভাব, ডেঙ্গু মোকাবিলায় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিচ্ছে সরকার
ডেঙ্গুতে প্রতিদিনই মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ঢাকার বাইরেও ব্যাপকভাবে বাড়ছে। তবে এখন পর্যন্ত সব বয়সীদের জন্য কার্যকর ভ্যাকসিন না থাকায় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, সরকার এই মুহূর্তে ভ্যাকসিন প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে ভাবছে না। কারণ, 'ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন এখনও অনেক ক্ষেত্রে গবেষণাধীন' এবং 'সব বয়সের জন্য কার্যকর ভ্যাকসিন এখনও নেই।'
তিনি আরও বলেন, কিছু দেশে সীমিত পরিমাণে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু 'কোনো দেশই এটি বিস্তৃতভাবে দিচ্ছে না।'
ডা. জাফর জোর দিয়ে বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিয়ন্ত্রণ এবং জনসচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, 'জ্বর হলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগীরা যদি শেষ পর্যায়ে হাসপাতালে আসে, তখন আমরা আর কিছুই করতে পারি না।'
তিনি উল্লেখ করেন, কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ সংক্রমণের এলাকায় প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় কাজ করছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত স্যালাইনের জোগান রয়েছে এবং ডেঙ্গুর এনএস১ পরীক্ষা ফ্রি করা হয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, 'যদি আমরা সবাই সচেতন না থাকি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে।'
গতকাল আরও তিনজনের মৃত্যুর পর এ বছরের মোট ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১৮-এ, যা প্রাদুর্ভাবের উদ্বেগজনক প্রবণতা নির্দেশ করছে।
এখন পর্যন্ত বিশ্বে দুইটি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন আছে—ডেংভ্যাক্সিয়া ও কিউডেঙ্গা—তবে উভয়ই এখনও বাংলাদেশে ব্যবহার উপযোগী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য বর্তমানে কিউডেঙ্গা (টিএকে-০০৩) একমাত্র বিস্তৃতভাবে সুপারিশকৃত ভ্যাকসিন। সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, সংক্রমণ বেশি এলাকায় ৬–১৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এটি ব্যবহার করা উচিত।
এই ভ্যাকসিনের দুই ডোজ লাগে, যা তিন মাসের ব্যবধানে দিতে হয়। এটি বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে ব্যক্তিগত বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
ডেংভ্যাক্সিয়া ১৯ থেকে ২১টি দেশে অনুমোদিত, যার মধ্যে ব্রাজিল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও রয়েছে। তিন ডোজের এই ভ্যাকসিন ছয় মাসের ব্যবধানে দিতে হয় এবং এটি যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং আরও কয়েকটি দেশে অনুমোদিত।
২০২৪ সালে ব্রাজিলের দৌরাডোস শহরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ডেঙ্গু ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি চালু হয়, যেখানে লক্ষ্য ছিল ১,৫০,০০০ জনকে টিকা প্রদান।
বিশ্বব্যাপী অগ্রগতির পরও বাংলাদেশে এখনও অনুমোদিত কোনো ডেঙ্গু ভ্যাকসিন কর্মসূচি নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম. মুশতাক হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের দেশের উপযোগী ডেঙ্গু ভ্যাকসিন এখনো নেই। আইসিডিডিআরবি-তে তৈরি একটি ভ্যাকসিনের সেকেন্ড ফেজ ট্রায়াল হয়েছে, থার্ড ফেজ ট্রায়াল এবং অনুমোদনের পর সেটি আমাদের দেশে উপযোগী হতে পারে। যতক্ষণ তা অনুমোদিত হবে না, ততক্ষণ আমাদের ডেঙ্গু প্রতিরোধে মনোযোগ দিতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র থেকে বের হয়ে বিকেন্দ্রীকভাবে পরিচালনা করতে হবে।
বাংলাদেশের শীর্ষ স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের লার্নার মেডিকেল কলেজের সঙ্গে সহযোগিতায় একটি এক ডোজের চতুর্মুখী ডেঙ্গু ভ্যাকসিন 'টিভি০০৫' তৈরি করছে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সফলভাবে সেকেন্ড ফেজ ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে, যা চারটি ডেঙ্গু সিরোটাইপের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছে।
আইসিডিডিআরবি এবং ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, তাদের এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশের ডেঙ্গু প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আইসিডিডিআরবি সূত্রে জানা গেছে, 'টিভি০০৫-এর থার্ড ফেজ ট্রায়াল শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আগামী মাসে আশা করা যাচ্ছে।'
ডেঙ্গু পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৮০,৬৩৪ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৯১২ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের ৬৫% পুরুষ এবং সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত বয়সী জনগোষ্ঠী ১৬–২৫ বছর।
মৃত্যুর হিসাব অনুযায়ী, ৫৩.২% পুরুষ এবং সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো ০–১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে বেশি মৃত্যু ঘটছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার টিবিএসকে বলেন, এই প্রাদুর্ভাব 'এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে' এবং নভেম্বর জুড়ে সংক্রমণ চলতে পারে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, কেবল ফগিং নয়, সম্পূর্ণ ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট (আইভিএম) পদ্ধতিতে যেতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত কর্মী, আধুনিক সরঞ্জাম এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের ডেঙ্গু কন্ট্রোল টাস্কফোর্স, যাতে পর্যবেক্ষণ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়।
