এলএনজি সরবরাহ বিঘ্নিত, আরও দুই মাস চলতে পারে গ্যাস সংকট

এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণের কারণে দেশে গ্যাস সরবরাহের সংকট আরও দুই মাস স্থায়ী হতে পারে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) কর্মকর্তারা জানান, এলএনজি টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলছে বলে গ্যাস সরবরাহ কম। দুটি পাইপলাইনের একটির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ গত নভেম্বরে শুরু হয়। আজ (১৮ জানুয়ারি) এটির কমিশনিং হওয়ার কথা রয়েছে।
রক্ষণাবেক্ষণকৃত এই লাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু হলে অন্যটির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু হবে। সেটি সম্পন্ন হতে দুই মাস সময় লাগবে বলে জানা কর্মকর্তারা।
নভেম্বর থেকে শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলসহ বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কারখানার মালিকরা উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ।
দুটি পাইপলাইন দিয়ে এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিত না হলে আগামী মার্চ বা এপ্রিলের আগে গ্যাস-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
আরপিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (এলএনজি) মো. শাহ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ থাকলেও জানুয়ারিতে এই সরবরাহ প্রায় ৪০ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এখন গ্যাসের সরবরাহ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, এলএনজি আমদানি করতে হয় স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে। ডলার সংকটের কারণে এই মুহূর্তে এলএনজি আমদানি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম। কিন্তু এখন এলএনজি টার্মিনালে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান তারা।
কারখানাগুলো তীব্র ক্ষতিগ্রস্ত
ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তীব্র গ্যাস সংকটের মুখে পড়েছে, যার ফলে পোশাক, সিরামিক, সিমেন্ট, ইস্পাতসহ বিভিন্ন খাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
গ্যাসের চাপের তারতম্যের কারণে কারখানার যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা। তারা বলছেন, গ্যাস কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে শিডিউলভিত্তিক গ্যাস সরবরাহ করতে পারে। এতে কারখানা মালিকদের বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কারখানা চালুর প্রস্তুতি থাকবে।
তৈরী পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় ডায়িং এবং ফিনিশিং খাতে শিডিউল ধরে রাখা যাচ্ছে না। কারখানাগুলো সময়মতো ফেব্রিক পাচ্ছে না। এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
তারা বলছেন,রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এমনিতেই তৈরি পোশাক শিল্প সংকটের মধ্যে রয়েছে। তার মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ার ঘটনা। এর মধ্যে গ্যাস সংকট এই পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিচ্ছে।
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, গ্যাসের চাপ কম থাকলে টেক্সটাইল কারখানায় রঙের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। আবার বিকল্প জ্বালানি দিয়ে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে খরচ বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। 'উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় শিপমেন্ট শিডিউল বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।'
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে গ্যাস সংকট চরমে উঠেছে। 'চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভার এলাকায় সংকট বেশি; যে কারণে এসব এলাকার ডাইং কারখানাগুলো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন বলেন, সিরামিক কারখানার মেশিনগুলো সারা বছরই ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়।
'একবার বন্ধ হয়ে গেলে এসব মেশিনের আয়ুষ্কাল কমে যায়। গ্যাসের চাপ কম থাকায় দিনের একটা বড় অংশ আমাদের কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ার পাশাপাশি যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতেও আছি আমরা,' বলেন তিনি।
কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন বলেন, গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছে সিমেন্ট খাত। এমনিতেই কাঁচামালের উচ্চমূল্যের কারণে উৎপাদন ব্যয় ঊর্ধমুখী। এর মধ্যে বিকল্প জ্বালানি দিয়ে উৎপাদন চালু রাখার কারণে আরও ৩০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ কমেছে ১১ শতাংশ
চলমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে চাহিদার চেয়ে ১১ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ কম।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আমিনুর রহমান টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রামে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। 'কিন্তু আমরা সরবরাহ পাচ্ছি প্রায় ২৯০ মিলিয়ন ঘনফুট,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সামনে বোরো মৌসুম। তাই চট্টগ্রামের দুটি সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হয়েছে। এর ফলে অন্য খাতে গ্যাস সরবারাহ কিছুটা কম।
অফিশিয়াল তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রামে ভারী শিল্পকারখানা রয়েছে ১ হাজার ২০০টি। গ্যাস সংকটের কারণে ভারী শিল্পকারখানাগুলো সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছে। ভারী শিল্প খাতের মধ্যে রড়, সিমেন্ট, শিপ ব্রেকিং, ঢেউটিন, গার্মেন্টস শিল্প খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে।
রড উৎপাদনকারী বিএসআরএম গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তপন সেন গুপ্ত বলেন, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে গ্যাসের সংকট আরও প্রকট হয়েছে। 'প্রেসার কম থাকায় ফার্নেস অয়েল দিয়ে উৎপাদন চালু রেখেছি। এতে টনপ্রতি রড উৎপাদনে ১ হাজার টাকা খরচ বেড়ে গেছে,' বলেন তিনি।