২৩২৬ জন ডাক্তারের প্রশিক্ষণে জনপ্রতি বরাদ্দ ১৬৭৬৬ টাকা, ব্যয় হলো পাঁচগুণ

স্বাস্থ্য খাতের একটি প্রকল্পে পরিবার পরিকল্পনা সেবাদানকারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির করতে ২৩২৬ জন ডাক্তারের 'রিফ্রেশার' প্রশিক্ষণে জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল ১৬৭৬৬ টাকা। কিন্তু নির্ধারিত ব্যয়ের সাড়ে পাঁচগুণ বা ৫৫২% ব্যয় করছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। মূলত প্রশিক্ষণার্থীদের সম্মানি দিতেই এ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।
এছাড়া প্রসব পরবর্তী স্থানীয় পরিবার পরিকল্পনা, বৈদেশিক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করার অভিযোগ উঠেছে।
এ অনিয়ম হয়েছে চলমান "ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপটিভ সার্ভিসেস ডেলিভারী প্রোগ্রাম (সিসিএসডিপি) কর্মসূচিতে। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক নিবিড় পরিবীক্ষণ (খসড়া) প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
কর্মসূচিতে ডাক্তার, নার্সসহ অন্যান্যদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ অবস্থায় যদি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাহলে এ খাতের ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে সরকারের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ চতুর্থ স্বাস্থ্য ,জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচির আওতায় সিসিএসডিপি পরিকল্পনা ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ পরিকল্পনার মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
জানতে চাইলে সিসিএসডিপির পরিচালক ডা. নুরুন নাহার বেগম টিবিএসকে বলেন, সরকারি বেতন স্কেল ও গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে। আবার ডাক্তাদের বেতন স্কেলেও কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এ কারণে প্রশিক্ষণে ডাক্তারদের সম্মানি বেড়েছে। যেমন বৈদেশিক প্রশিক্ষণে যাওয়া ডাক্তার জনপ্রতি আরও একলাখ টাকা ভাতা পাচ্ছে। তবে প্রশিক্ষণ খাতে মোট ব্যয় আর বাড়বে না, কিছু প্রশিক্ষণ কাটছাঁট হবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সালের সরকার ঘোষিত বেতন স্কেলে কোনো গ্রেডেই ১০% এর বেশি বেতন বৃদ্ধির কথা বলা নেই। সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ করে বেতন বাড়লেও তা চার বছরে দাঁড়ায় ৪৬.৪১%। যদি কোন কর্মকর্তার গ্রেডও উন্নীত হয়, সেক্ষেত্রে আরও ২০% থেকে ৩০% বেতন বাড়তে পারে। কর্মসূচির বেতন ও গ্রেড পরিবর্তনের কারণে কর্মকর্তাদের ৫৫২% সম্মানি বৃদ্ধি কখনো যৌক্তিক হতে পারে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের সদস্য জয়নুল বারী বলেন, ২০১৫ সালের বেতন-স্কেল ধরেই প্রকল্পের প্রশিক্ষণ, ভাতা বা অন্যান্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাবে। ২০১৭ সালের অনুমোদিত প্রকল্পে বেতন স্কেলের কারণে প্রশিক্ষণের সম্মানি বা অন্য কোনো ভাতা সাধারণত বাড়ার কথা না। প্রশিক্ষণের সম্মানি, দৈনিক ভাতা, যাতায়াত ভাতা নির্ধারণে সরকারি পরিপত্র রয়েছে। এর বাইরে যাওয়া উচিত নয়।
ডা. নুরুন নাহার বেগম আরও জানান, চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচি অনুমোদনে পর এ কর্মসূচির প্রশিক্ষণ, সেমিনার, কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের ভাতা নির্ধারণে নতুন পরিপত্র জারি করে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ কারণে পরে প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় বেড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় অনুমোদন পায় ২০১৭ সালের ২১ মার্চ। আর এ কর্মসূচির প্রশিক্ষণ , সেমিনার ও কর্মশালার ভাতা নির্ধারণে পরিপত্র জারি হয় ওই বছরের ৬ জুন। কিন্ত প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির আগে থেকে এ সংক্রান্ত পরিপত্রের বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে থাকা সবগুলো সংস্থা এ বিষয়ে অবগত ছিল। এবং সে অনুযায়ী প্রকল্প তৈরি করা হয়। এছাড়া প্রকল্প প্রস্তাব স্বাস্থ্য বিভাগের সম্মতিতে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাবদ ৩০০ জনের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০.৮০ কোটি টাকা। করোনার কারণে এখন বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বন্ধ রয়েছে। তবে মহামারির আগের ১১৭ জন ডাক্তার জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনে ৭ থেকে ১০ দিনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণে যান। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সাধারণ জন্মনিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা অর্জনে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশগুলোর অভিজ্ঞা নিতে ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালয়শিয়াতে সফর করেন চিকিৎসকেরা । এছাড়া করোনার আগে তিনটি উন্নত দেশ ব্রাজিল, কানাডা, ইতালিতেও পাঠানো হয়েছে ডাক্তারদের।
এদিকে আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রসব পরবর্তী স্থানীয় পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণেও জনপ্রতি অতিরিক্ত ১২৯% অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এ প্রশিক্ষণে বরাদ্দ রয়েছে ৪.৫৭ কোটি টাকা। অথচ এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক ডাক্তারকে প্রশিক্ষণ দিতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫.১০ কোটি।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ট্রেনিং খাতে জনপ্রতি অতিরিক্ত ব্যয়ের ধারাবাহিকতায় ওয়ার্কশপ আয়োজনে জনপ্রতি প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করা হয়েছে। এ মাঠ কর্মীদের ওরিয়েন্টশন ওয়ার্কশপ এবং এলএআরসি এবং পিএম ওরিয়েন্টশন ওয়ার্কশপেও অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করা হয়েছে। এছাড়া রিজিওনাল ওয়ার্কশপে জনপ্রতি ৩০৮% বেশি ব্যয় করা হয়েছে।
দীর্ঘ মেয়াদী এবং স্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা সেবায় সক্ষমতা বাড়াতে পাঁচ হাজার প্যারামেডিককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অগ্রগতি খুব কম। পাঁচ বছরে এ প্রশিক্ষণের অগ্রগতি মাত্র ১.৯৬%। স্থানীয় প্রশিক্ষণ (এমআর/এমআরএম/ প্যাক-এফপি পদ্ধতি) খাতে ৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা থাকলেও এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি।
মূল পরিকল্পনায় পরামর্শকদের বেতন হিসেবে কোনো ব্যয় বরাদ্দ না থাকলেও চলতি অর্থবছরে এ খাতে ১৭.৫০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এটিকে আর্থিক শৃঙ্খলা ও পরিকল্পনা পরিপন্থী বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ দেওয়ার পক্ষে 'নিড অ্যানালাইসিস' করা হচ্ছে না। এছাড়া সিসিএসডিপি দপ্তর বা অন্য কোথাও কতজনকে কোনো বিষয়ে এবং কোন অর্থবছরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তার কোনো তথ্য নেই। প্রশিক্ষণার্থীদের কোনো তালিকাও পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের সদস্য জয়নুল বারী বলেন, অনুমোদিত প্রকল্প প্রস্তাবে খাত ভিত্তিক যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার চেয়ে বেশি ব্যয় যেন না হয়ে যায়। আরও যদি ব্যয় করতেই হয়, সেক্ষেত্রে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করতে হয়। অনেক সময় জরুরি অবস্থার কারণে অনুমোদনের চেয়ে বেশি ব্যয় করা হয়। আর যদি এক্ষেত্রে অনিময় হয় তবে সেক্ষেত্রে অডিট আপত্তি হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টানন্যাশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প থেকে সম্পদ আহরণ করা কর্মকর্তাদের লক্ষ্য পরিণত হয়েছে। প্রশিক্ষণ খাত অর্থ সংগ্রহের অন্যতম প্রধান উৎস। এমনিতে প্রশিক্ষণের জন্য অনেক বেশি ব্যয় ধরা হয়। তারপরে অতিরিক্ত অর্থব্যয়ও করা হয়।
তিনি বলেন, আইএমইডির এখন শুধু এ প্রকল্পে অনিয়ম চিহ্নিত করলেই হবে না। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।