চট্টগ্রাম ও রংপুরে দুই হাসপাতাল নির্মাণে চীনের কাছে ৩,৪২৫ কোটি টাকার অনুদান চায় বাংলাদেশ

বেইজিংয়ের আশ্বাসের পর সরকার দুটি বড় হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা অনুদান চেয়ে চীনের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব জমা দিয়েছে। আরেকটি প্রস্তাব প্রস্তুতির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। একটি হাসপাতাল চট্টগ্রামে, অপরটি রংপুর বিভাগে নির্মিত হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস), পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প দুটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১০৭ কোটি টাকা।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় নির্মিতব্য হাসপাতালটি হবে ৫০০-৭০০ শয্যার। এর ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন ১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা দেবে বলে আশা করা হচ্ছ । অন্যদিকে রংপুরের ১ হাজার শয্যার হাসপাতালটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। এই টাকার পুরোটাই অনুদান হিসেবে পাওয়ার কথা রয়েছে।
কর্মকর্তারা বলেন, প্রকল্প দুটি ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। রংপুর হাসপাতালের প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) ইতিমধ্যে চীনে পাঠানো হয়েছে। আর চট্টগ্রামের হাসপাতালটির প্রস্তাব পরিকল্পনা উপদেষ্টার অনুমোদন পাওয়ার পর বৈদেশিক অর্থায়নের জন্য ইআরডিতে জমা দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইআরডির একজন কর্মকর্তা বলেন, 'দুই দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতা হওয়ায় রংপুর হাসপাতালের পিডিপিপি ইতিমধ্যে চীনে পাঠানো হয়েছে। আগামী মাসের শুরুতে ইআরডির একটি নির্ধারিত বৈঠকের পর চট্টগ্রাম হাসপাতালের জন্য আনুষ্ঠানিক অনুদান প্রস্তাব পাঠানো হবে।'
ভিসা জটিলতা ও চীনের প্রতিশ্রুতি
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ভারতের ভিসা প্রাপ্তিতে জটিলতা দেখা দেয়। ফলে বাংলাদেশি রোগীদের ভারতে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ ব্যাহত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চীন কুনমিং শহরের হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। পাশাপাশি বাংলাদেশে তিনটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়।
জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার চীন সফরের সময় এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি ইআরডিতে একটি বৈঠক হয়; সেখানে চীনের সহায়তার জন্য তিনটি প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও রংপুরের হাসপাতাল দুটি নিয়ে কাজ এগিয়ে চলছে।
গত ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবু জাফর নিশ্চিত করেন, রংপুর বিভাগের নীলফামারীতে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল, চট্টগ্রামে একটি জেনারেল হাসপাতাল ও ঢাকায় একটি পুনর্বাসন হাসপাতাল নির্মাণে সহায়তা দেবে চীন।
নীলফামারীর ১ হাজার শয্যার হাসপাতালটি তিস্তা প্রকল্পের কাছে গড়ে তোলা হবে। অন্যদিকে ঢাকার ধামরাইয়ে পুনর্বাসন হাসপাতালটি নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছে।
গত ৭ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান জানান, চীনের অর্থায়নে উত্তরাঞ্চলে একটি মেডিকেল সিটি, দক্ষিণে একটি মহিলা হাসপাতাল ও পূর্বাঞ্চলে একটি জেরিয়াট্রিক (প্রবীণদের জন্য) হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে।
তবে গত ২৪ আগস্ট এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. সায়েদুর মন্তব্য করতে রাজি হননি।
চট্টগ্রাম হাসপাতাল
পিডিপিপি অনুসারে, চট্টগ্রামের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী জেনারেল হাসপাতাল হবে টারশিয়ারি লেভেলের বিশেষায়িত হাসপাতাল। এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সমন্বয় ঘটানো হবে।
এই হাসপাতালে হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ, কিডনি রোগ ও সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের পাশাপাশি আইসিইউ, এইচডিইউ, ডায়ালাইসিস ও কার্ডিয়াক কেয়ার সুবিধা এবং একটি পূর্ণাঙ্গ দন্ত বিভাগ থাকবে।
হাসপাতালটিতে একটি আধুনিক বহির্বিভাগ, সার্বক্ষণিক জরুরি সেবা, সার্জিক্যাল থিয়েটার কমপ্লেক্স এবং এমআরআই, সিটি স্ক্যান ও ল্যাবরেটরি সুবিধা সংবলিত উন্নত রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা থাকবে।
হাসপাতালের সঙ্গে একটি নার্সিং কলেজ সংযুক্ত থাকবে, যা জনবলের ঘাটতি মেটাতে সাহায্য করবে। সহায়ক পরিষেবা হিসেবে থাকবে সিএসএসডি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল স্বাস্থ্য রেকর্ড এবং একটি মর্গ ও ফরেনসিক ইউনিট। চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের জন্য আবাসিক সুবিধাও থাকবে।
হাসপাতালটি চট্টগ্রাম শহরের ৩২ লাখ এবং পুরো জেলার ৯০ লাখের বেশি মানুষকে সেবা দেবে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইতিমধ্যে ধারণক্ষমতার ১৩০ শতাংশের বেশি রোগী নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে নতুন হাসপাতালটি বিদ্যমান চাপ কমাবে এবং টারশিয়ারি লেভেলের চিকিৎসাসেবার মান বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রংপুর হাসপাতাল
রংপুরের হাসপাতালটি উত্তরাঞ্চলের জন্য বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবে, যার মধ্যে থাকবে ক্যানসার, স্নায়ুরোগ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ এবং শিশু ও নবজাতকদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র।
এ হাসপাতালে ২০০টি মেশিনসহ একটি বিশেষায়িত ডায়ালাইসিস কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এছাড়া কিডনি রোগের চিকিৎসার উন্নতির জন্য সারা দেশে আরও ১ হাজার ডায়ালাইসিস মেশিন বিতরণ করা হবে। হাসপাতালটিতে মডিউলার অপারেশন থিয়েটার, জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষ ও পিইটি-সিটি, এমআরআই এবং মলিকিউলার ল্যাবসহ একটি ডায়াগনস্টিক ব্লক থাকবে।
পরিকল্পনা নথিতে বলা হয়েছে, ঢাকার টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ কমানো এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীদের দূর-দূরান্তে ভ্রমণের খরচ কমানোর জন্য এই হাসপাতালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কর্মকর্তারা বলেন, এই দুটি হাসপাতাল শুধু স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতাই বাড়াবে না, তার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও জরুরি সেবাগুলোকেও শক্তিশালী করবে। চট্টগ্রাম ও রংপুরে হাসপাতাল স্থাপনের মাধ্যমে সরকার মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো এবং রাজধানীর বাইরে বিশেষায়িত চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েছে।