ফোর্বসের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ তালিকায় বাংলাদেশের ৯ উদ্যোক্তা

প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী 'ফোর্বস' ২০২১ সালে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখায় অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সী এশীয় অঞ্চলের ৩০০ তরুণের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এ বছর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন নয়জন বাংলাদেশি তরুণ।
এন্টারপ্রাইজ টেকনোলজি, রিটেইল এন্ড ই-কমার্স এবং সামাজিক প্রভাব- এ তিনটি শ্রেণিতে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা স্থান করে নিয়েছেন।
সোমবার (১৯ এপ্রিল) ফোর্বস তার ষষ্ঠ বার্ষিক 'থার্টি আন্ডার থার্টি এশিয়া' তালিকা ঘোষণা করে।
এর মধ্যে শেহজাদ নূর তাওস প্রিয়, মোতাসিম বীর রহমান এবং মীর সাকিব, এই তিনজন বাংলাদেশি তরুণ উদ্যোক্তা, "ফোর্বস থার্টি আন্ডার থার্টি এশিয়া ২০২১" তালিকার এন্টারপ্রাইজ টেকনোলজি বিভাগে স্থান পেয়েছেন।

শেহজাদ নূর তাওস প্রিয় (২৪) এবং মোতাসিম বীর রহমান (২৬) তাদের আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই ভিত্তিক উদ্যোগ 'গেজ' এর জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন।
সিঙ্গাপুর এবং বাংলাদেশ ভিত্তিক এআই স্টার্টআপ গেজ অনলাইন লেনদেনের জন্য ভিজ্যুয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি সরবরাহ করে।
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এআই স্টার্টআপটি ঘর্ষণহীন অনলাইন চেকআউট তৈরি করার দাবি করে।
গেজের ফেসবুক পেইজের তথ্য অনুসারে, তারা এপিআই ডেভেলপারদের জন্য একটি পাসওয়ার্ডহীন সাইন বা গেজপাস তৈরী করে যা মূলত যেকোন ওয়েবক্যাম বা বায়োমেট্রিক সেন্সরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সংস্থাটি তহবিল হিসাবে ১০ লাখ ডলার সংগ্রহ করেছে এবং এর গ্রাহকদের মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত। এর আগে এটি ২০২০ সালে 'স্টার্টআপ ওয়ার্ল্ড কাপ বাংলাদেশ' এবং ২০১৯ সালে সেরা স্টার্টআপের জন্য বাংলাদেশ বিজনেস ইনোভেশন পুরষ্কার জিতে নেয়।
গেজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শেহজাদ নূর তাওস প্রিয় মাত্র ২১ বছর বয়সেই আইবিএম রিসার্চের কাছে তার প্রথম উদ্যোগের পেটেন্ট (স্বত্ব) দাবি করেন। অন্যদিকে এর অপর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিওও মোতাসিম বীর রহমান মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনপ্রিয় সামাজিক নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম 'নগরবালক' তৈরী করেন।
মীর সাকিব তার স্টার্টআপ ক্র্যামস্ট্যাকের জন্য ফোর্বসের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।
মূলত তথ্য-উপাত্ত বা ডেটা নিয়ে কাজকারবার করে ক্র্যামস্ট্যাক। এটি একটি বিজনেস ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য খোঁজা, বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করতে পারে।
ক্র্যামস্ট্যাকের ধারণার পেছনে রয়েছে গুগল সার্চের মত এমন একটি অনুসন্ধানমূলক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যা ব্যবহারকারীদের ব্যবসায়িক বিভিন্ন ডেটার উৎস খুঁজতে সহায়তা করবে। সাধারণ চোখে যেসব তথ্যকে গুরুত্বহীন মনে হয় ক্র্যামস্ট্যাক সেটিও বিশ্লেষণ করে অর্থবোধক ও কার্যকর করে তুলতে পারে।
বর্তমানে ক্র্যামস্ট্যাকের গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ, অর্থ, উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবা এবং খুচরা খাত; বিসিজি, ইউএনডিপি এবং ন্যাশনাল ব্যাংকও অন্তর্ভুক্ত। মহামারী চলাকালীন করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং অভিবাসন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সরকারী ডেটা সরবরাহ করেছে। নেদারল্যান্ডসের রকস্টার্ট, টেলিনোরের গ্রামীণফোন এবং অ্যাঞ্জেল বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তারাও ১০ লাখ ডলারের ওপর তহবিল সংগ্রহ করেছে।
সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট বা সামাজিক প্রভাব ক্যাটাগরির আওতায় বাংলাদেশের তিনজন সম্মানীত হয়েছেন। এরা হলেন 'অ্যাওয়ারনেস থ্রিসিক্সটি' এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা- রিজভী আরেফিন (২৬) ও শমী চৌধুরী (২৬) এবং অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশনের আহমেদ ইমতিয়াজ জামি (২৭)।
রিজভী আরেফিন এবং শমী চৌধুরী কুয়ালালামপুর ভিত্তিক সেবামূলক সংস্থা অ্যাওয়ারনেস থ্রিসিক্সটি প্রতিষ্ঠা করেন যা তরুণদের একত্রিত করে মানুষের জীবন উন্নতকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্বের ২৩টি দেশে প্রতিষ্ঠানটির এখন ১৫০০ ভলান্টিয়ার রয়েছে যারা হাত ধোয়া, পানি, পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা (ওয়াশ) বিষয়ক কর্মশালা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পরিবেশবাদী উদ্যোগ পরিচালনা করে থাকে। এখন পর্যন্ত, তাদের প্রচারে দেড় লাখের ওপর মানুষ যুক্ত হয়েছে। রিজভী এবং শমীর কাজ এর আগে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
আহমেদ ইমতিয়াজ জামি ২০১০ সালে দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, মানবাধিকার ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করার জন্য অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। অতীতে এ প্রতিষ্ঠানটি এক মিলিয়নের বেশি মানুষকে সহায়তা প্রদান করেছে, ৫০০ সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করেছে, সাত জেলার ৫৫০টি পরিবারকে ক্ষমতায়নে সাহায্য করেছে এবং প্রায় ১০ হাজার রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা সরবরাহ করেছে। এছাড়া অভিযাত্রিকের রয়েছে নিজস্ব স্কুল এবং অনুদান কর্মসূচী। করোনা মহামারীর সময়েও পিছিয়ে থাকে নি অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশন।
প্রায় দুই লাখ লোককে বিনামূল্যে সবজি, ৬৫ হাজার পরিবারকে নিত্যপণ্য এবং ৯০ হাজার পরিবারের খাবারের সংস্থান করেছে এই প্রতিষ্ঠান। সরকারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মতো কর্পোরেট দাতাদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে অভিযাত্রিক ২ লাখ ৩৫ হাজার ডলার অর্থ সহায়তা সংগ্রহ করেছে।
এরপরেই যাদের নাম চলে আসে তারা হলেন জাহিন রোহান রাজিন (২২) এবং রিজওয়ানা হৃদিতা (২৮)। তারা 'হাইড্রোকুয়োপ্লাস' স্টার্ট-আপটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটি নিরাপদ পানি নিয়ে কাজ করে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সেবামূলক সংস্থা পানির গুনগত মান নিয়ে করা তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে।
এর আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে পানির গুণাগুণ ও পানিতে থাকা জীবাণু শনাক্তের কৌশল বের করেন জাহিন। ২০২০ সালে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে জাতিসংঘের এমন ১৭ জন তরুণ নেতা বা 'ইয়াং লিডার্সের' তালিকায় স্থান পান বাংলাদেশি এই তরুণ প্রযুক্তিবিদ।
তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন রিটেইল এন্ড ই-কমার্স ক্যাটাগরিতে স্থান করে নেয়া মরিন তালুকদার। তিনি বাংলাদেশী ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম পিকাবুর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ১৫ ই মে ২০১৬ এটি যাত্রা শুরু করে।
২০২১ সালের ভিতর এটি দেশব্যাপী দেড়শটি দোকান (ফিজিক্যাল স্টোর ) খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে ৬০ লাখ ডলার অর্থ সংগ্রহ করেছে পিকাবু। এর আগে মরিন ইহাটবাজার ডট কম নামক আরেকটি ই-কমার্স সাইট খুলেছিলেন, তবে ২০১৬ সালে তিনি এটি আরেকজন সহ-প্রতিষ্ঠাতার কাছে বিক্রি করে দেন।