প্রচলিত গণ্ডির বাইরে ভাবুন, কিছু ঝুঁকি নিন: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ইউএনএইচসিআর প্রধান

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে প্রচলিত গণ্ডির বাইরে চিন্তা করার এবং এ পদক্ষেপ বাস্তবায়নে কিছু ঝুঁকি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি।
যুদ্ধ ও সহিংসতায় বিশ্বজুড়ে বাস্তুচ্যুত হওয়া কোটি কোটি মানুষের দুর্দশার কথা উল্লেখ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি এ আহ্বান জানান। ইউএনএইচসিআরের ওয়েবসাইটে চিঠিটি প্রকাশ করা হয়েছে।
চিঠির শুরুতে গ্রান্ডি লিখেন, 'মি. প্রেসিডেন্ট। এটি যুদ্ধের মৌসুম। এখন সংকটের সময়।'
এরপর তিনি গাজা, ইউক্রেন, মিয়ানমার, কঙ্গো, হাইতি, সিরিয়া, সুদানসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলমান সংঘাতে ভুক্তভোগী ও বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষদের কথা উল্লেখ কথা উল্লেখ করেন।
নিরাপত্তা পরিষদ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে গ্রান্ডি লেখেন, যুদ্ধ প্রতিরোধ ও বন্ধ করা, শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করাই নিরাপত্তা পরিষদের ম্যান্ডেট। এটাই আপনার প্রাথমিক দায়িত্ব। আমাকে আবারও এ কথা বলার জন্য ক্ষমা করবেন। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে এই পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে ব্যর্থ হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের কথা উল্লেখ করে চিঠিতে গ্রান্ডি লেখেন, আমরা গত আট বছর ধরে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে স্থবিরতার মধ্যে দিয়ে হেঁটেছি—এটি একটি কানাগলি। রোহিঙ্গাদের দুর্দশার সমাধানের পথ খুঁজে পেতে এবং শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর পরিবেশের সূচনা করতে হলে, সব পক্ষের সঙ্গে সংলাপ শুরু করাটা একেবারে প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
এতে ইউএনএইচসিআরসহ মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো আবার তাদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং জরুরি মানবিক সহায়তা কার্যক্রম নিরাপদে ও স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে পারবে।
এসব পদক্ষেপ পরবর্তী পর্যায়ে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু করার ভিত্তি তৈরি করতে পারে। আমি জোর দিয়ে বলছি—এই প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে— এটা তখনই সম্ভব হবে যখন রাখাইন অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি সে রকম হবে। আর সেখান থেকেই রোহিঙ্গাদের অন্যান্য আইনি অধিকার আদায়ের পথও উন্মুক্ত হতে পারে।
তিনি লেখেন, এটি একটি দীর্ঘপথ। কিন্তু আমি আপনাদের এই গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে চিন্তা করার এবং ঝুঁকি নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমি আশা করি, কাউন্সিল মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর—বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার ওপর দৃঢ়ভাবে তাদের মনোযোগ ধরে রাখবে।
গত আট বছরে মিয়ানমারে পরিস্থিতি এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে। তাতমাদাও (মিয়ানমারের সেনাবাহিনী) ও বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে চলমান সংঘাতে গোটা দেশ ও আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক দুর্ভোগ ও বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। মাস খানেক আগে আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্পে এ সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
এসবের মধ্যে বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা আরও গভীর হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই হয়েছে। বর্তমানে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপন করছে, যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছেন।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রোহিঙ্গারা বছরের পর বছর ক্যাম্পে বন্দিজীবন যাপন করছে। তাদের কাজের সুযোগ নেই, নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও নেই। তারা পুরোপুরি মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল—যা দিন দিন আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। তাই এটি জেনে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে অনেক রোহিঙ্গা তরুণ নতুন জীবনের সন্ধানে বিপজ্জনক সমুদ্রপথ পাড়ি দিচ্ছে কিংবা সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগ দিতে যাচ্ছে।
এখন এই স্থবিররতা ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে যে সংঘাত চলছে, তার সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনেকেই বলবেন, এ পরিস্থিতিতে কোনো সমাধান সম্ভব নয়। এর কারণও আমরা জানি: বহু প্রাণ ঝরছে, বৈষম্য এখনো চলছে, আর স্বার্থের সংঘাতও অসংখ্য। কেউ কেউ বলবেন, এ সংকট শিকড় থেকে কখনোই কার্যকরভাবে সমাধান করা যাবে না—এটাও হয়তো ঠিক।
চিঠিতে নিরাপত্তা পষিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দয়া করে আপনারা কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরাজয় মেনে নেবেন না। আজ আমি আবারও ১২ কোটি ৩০ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষের পক্ষ থেকে কথা বলছি, যারা যুদ্ধের প্রথম ভুক্তভোগী এবং অনেক দিক থেকে সংঘাত ও নিপীড়নের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়ে তারা নিরাপত্তার আশ্রয় খুঁজেছে এবং খুঁজে চলেছেন। তারা এখনো নিরাপদে ফেরার স্বপ্ন দেখছেন। আমি জানি, তারা কখনো হাল ছাড়বেন না—তারাও চান না আমরা হাল ছেড়ে দিই।