কার্টুন পিপল: রুস্তম পালোয়ান থেকে গার্লস ডু কমিক্স

ক্লাস সিক্সে ইরাবতী যখন নতুন সেকশনে গেল, তখন তার সব সহপাঠীই নতুন। সবাই তার নাম জেনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। সবার মনেই এক প্রশ্ন—এ কেমন নাম? মেয়েটা কোন ধর্মের?
পরের দিন আরেক নতুন সহপাঠি তার নাম জানতে চাইলে ইরাবতী বলল, "চন্দ্রিকা নূরানী ইরাবতী।" বন্ধুটি খুশি হয়ে বলল, "বাহ্ সবগুলো রূপকথার নাম, কিন্তু নামের সঙ্গে তোমার চেহারার তো মিল নেই। রাজকন্যাদের চুল যে বড় হয়!"
নাম নিয়ে নানান সংকটের মধ্য দিয়ে যাওয়া ছোটবেলার ঘটনাগুলো উল্লেখ করে ইরাবতী এঁকেছেন কমিক্স 'নাম'।
সালসাবিল কামালের কমিক্সটির নাম 'কেন'? তার প্রধান চরিত্র বীরাঙ্গনা একজন সুপার উইম্যান। প্রথম ঘটনায় সে দুই অপহৃত শিশুকে গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচায়। এই খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় জানাজানি হলে একজন মন্তব্য করেন, 'বীরাঙ্গনা দেখতে এত বিশ্রী কেন? সুপারহিরোর তো চেহারাও সুন্দর হওয়া দরকার। একটু মেকাপ নিতে পারে না?'
পরের দিন একটি স্কুটার ও রেলগাড়ির মধ্যকার সংঘর্ষ এড়াতে সাহায্য করে বীরাঙ্গনা। কমেন্ট বক্সে গিয়ে দেখতে পায় একজন লিখেছে, 'ও (বীরাঙ্গনা) মেকাপ করছে, পুরাই ভুতের মতো লাগতেছে।' তারপরের একে একে বাক্যবাণ- 'এতো টাইট জামা পরে কেন, ওড়না জড়ায় না কেন।' শেষে ওড়না জড়িয়ে যখন আগুন নেভাতে যায়, তখন ওড়নায় আগুন লেগে তার হাত পুড়ে যায়। আবার নতুন বাণে বিদ্ধ হয়, 'মেয়ে হয়ে এতো হিরোগিরি দেখাতে কে বলেছে? মেয়েমানুষ আগে নিজেকে বাঁচাক, তারপর অন্যকে।'
ধ্রুবানী মাহবুবের কমিক্সের প্রধান পাত্রী ধ্রুবা ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার আগে নিজের গাত্রবর্ণ ও চেহারার গড়ন নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। অথচ ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখে একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও সেখানে উপস্থিত। সবাই তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে, কিন্তু মানুষটি নির্বিকার। ইন্টারভিউ দেয়ও খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। ধ্রুবা তার কাছে জানতে চায়, এতো চোখ উপেক্ষা করার সাহস সে কোথা থেকে পায়। মানুষটি বলে, অন্যের কথা ভেবে বাঁচলে নিজের মতো বাঁচাই হবে না কোনোকালে।
এমন ১৪টি কমিক্সের এক সংকলন গার্লস ডু কমিক্স এর 'পরিচয়'। ১৪ জন নারী কার্টুনিস্টের এই সংকলনের স্লোগান 'মেয়েদের আঁকায় মেয়েদের কমিক্স'। বস্তুত, সবমিলিয়ে ২৭ জন কার্টুনিস্ট। বাকি ১৩ জনের কার্টুন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজি সংকলন 'লাইনস অ্যান্ড ড্রিমস'।
আত্মপরিচয়, মানসিক স্বাস্থ্য, সৌন্দর্যের মাপকাঠি, পারিবারিক গঠন-কাঠামো, আত্মসচেতনতা ইত্যাদি বইগুলোর বিষয়। আধুনিকা ফাউন্ডেশন এবং ইএমকে সেন্টারের সহযোগিতায় কার্টুন পিপল কমিক্সগুলোর ঢাউস দুই সংকলন প্রকাশ করেছে। দুটিরই সম্পাদক কার্টুনিস্ট রাশাদ ইমাম তন্ময়, তিনি কার্টুন পিপলের প্রতিষ্ঠাতাও বটে।

পাঠশালা ছিল নীলক্ষেত
প্রকাশনা পর্যায় পর্যন্ত আসতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তন্ময় ও কার্টুন পিপলের কর্মীদের। ওই যাত্রার গল্প শুনতে গিয়েছিলাম তন্ময়ের কাছে, কার্টুন পিপলের স্টুডিওতে। সেগুলো একে একে বলবো, যার শুরু ২০০৫ সালে।
স্কুলবেলায় তন্ময়ের পাঠশালা ছিল নীলক্ষেত। মাঝে মধ্যে পুরানো বইয়ের দোকানগুলোয় হানা দিয়ে ম্যাড ম্যাগাজিন, চাচা চৌধুরী বা টিনটিন নিয়ে ঘরে ফিরতেন। আর ভীষণ ভক্ত ছিলেন উন্মাদ পত্রিকার। স্বপ্ন দেখতেন একদিন এই পত্রিকায় কার্টুন আঁকার।
এর পাশাপাশি তিন গোয়েন্দার কিশোর পাশারও তিনি ভক্ত ছিলেন। এক বাঙালি ছেলে দলের নেতৃত্ব দেয়, রহস্য সমাধান করে ফেলে, তাকে এটা আনন্দ দিত। আরেকটু বড় হওয়ার পর যখন মাসুদ রানার সঙ্গে পরিচয় হলো, তখন তিনি বেশি বেশি আত্মবিশ্বাসী হতে শুরু করলেন। বাংলাদেশের এক মানুষও যে বিশাল দেহী বিদেশি স্পাইদের সমান শক্তি ধরতে পারে, তা দেখে গর্বে তার প্রাণ ভরে যেত। এরই কিছু আগে-পরে তন্ময় ভেবেছিলেন, বাঙালিরাও পারে কথাটি একটু বদলে দিয়ে করবেন 'বাঙালিরা পারে'।
উন্মাদ দিল সাহস
২০০৬ সালে তন্ময়ের বয়স উনিশ। উন্মাদ পত্রিকায় যোগ দিয়েছিলেন কার্টুনিস্ট হিসাবে। পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবীব, যাকে গুরু বলে সম্বোধন করেন তন্ময়, তিনি এক অদ্ভুত মানুষ। ছোট-বড় সবার মতামতই জানতে চান, শোনেনও গুরুত্বের সঙ্গে; মানে তিনি সবাইকেই স্পেস বা জায়গাটুকু দেন। তন্ময় তাই অবাক হয়েছিল এটা দেখে যে, উন্মাদে তার মতামতেরও গুরুত্ব আছে।
তন্ময় বললেন, "আহসান হাবীব আমাকে কার্টুন আঁকার কলাকৌশল শেখাননি, বরং জীবনদর্শন শিখিয়েছেন। কী আঁকব, কেন আঁকব, কী বলা দরকার ইত্যাদি শিখেছি আহসান হাবীবের কাছে।"
দুই বছর পরেই তন্ময় একটি আন্তর্জাতিক কার্টুন প্রদর্শনীতে অংশ নিতে যান নেপাল। সেটা একটা বড় ঘটনা ছিল তার জন্য। বিশেষ করে এ কারণে যে, কার্টুনের সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ধারার সঙ্গে তিনি পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন ওই কম বয়সে।

এরও বছর পাঁচ পর তিনি ওয়ার্ল্ড প্রেস ইন্সটিটিউটের আমন্ত্রণে কার্টুনের এক ফেলোশিপে যোগ দিতে যান আমেরিকায়। সেখানেও অভিজ্ঞতা হয়েছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। আমেরিকার কার্টুনিস্টদের সাথে কথায় কথায় যখন বাংলাদেশের কথা আসে– তিনি তাদের জানান, 'আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায় কার্টুন ছাপা হয় প্রথম পৃষ্ঠায় এবং চার বা ছয় কলাম জুড়েও।' এ খবর শুনে অবাক হয়েছিলেন অন্য দেশের কার্টুনিস্টরা। কারণ বিশ্বের খুব কম উন্নত-গণতান্ত্রিক দেশেই এমনটা ঘটে।
অন্যান্য দেশে সাধারণত কার্টুন ছাপা হয় এডিটয়াল পেইজে, যে কারণে তারা সেগুলোকে পলিটিক্যাল কার্টুন বলেন না, বলেন এডিটরিয়াল কার্টুন। আমেরিকা হোক কিংবা নেপাল বা ইরান—তরুণ বয়সে বিভিন্ন দেশের কার্টুন চর্চার ধারা দেখার সুযোগ হয়েছিল তন্ময়ের।
ইরানের কার্টুনে কথা থাকে না
ইরানের কার্টুন সম্পর্কে বলছিলেন, "ওখানকার কার্টুনিস্টরা ডায়ালগ ছাড়া কার্টুন আঁকে, আর একটি ফ্রেমেই তারা একটি ফিল্ম তৈরি করে ফেলে। এটা খুবই শক্তিশালী ব্যাপার।"
"একটির কথা মনে আছে। যে প্রদর্শনীতে কার্টুনটি প্রদর্শিত হচ্ছিল তার শিরোনাম ছিল 'কষ্ট'। সেখানে দেখা যাচ্ছিল, একটি মৃহদেহকে কবরে শোয়ানো হয়েছে। মৃতের স্ত্রী কাঁদছিলেন, সঙ্গে তার শিশুপুত্রটিও। তবে পুত্রের আঙুল কবরের যে জায়গাটি নির্দেশ করছিল সেখানে পড়েছিল একটি ফুটবল। বাকি সবাই যখন কাঁদছিল লোকটির জন্য, শিশুটি কাঁদছিল তার প্রিয় ফুটবলটির জন্য। বাস্তব জীবনের রুঢ় সত্যগুলোকে পাশাপাশি একটিমাত্র ছবিতে বোঝানো সত্যি কঠিন, আরও কঠিন যখন তা বাক্যছাড়া হয়," বঅলোলেন তন্ময়।
'আমেরিকার পলিটিক্যাল কার্টুন বিশ্বজুড়ে মশহুর। কিন্তু আমেরিকা উন্নত দেশ, গণতন্ত্রের চর্চা হয় বেশি। তাহলে সেখানে কার্টুনের বিষয় কি, চ্যালেঞ্জটাই বা কোথায়?'– তন্ময় পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন কার্টুনিস্টের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "যেহেতু আমাদের এখানে কার্টুনের প্রতি প্রত্যাশা বেশি তাই কার্টুন দিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি করাটাই চ্যালেঞ্জ। সমাজ-সংস্কৃতির খুব গভীরে ডুব দিয়ে বিষয় খুঁজে আনতে হয়, একসঙ্গে প্রকাশটা হতে হয় সরল।"
দেশে ফেরার পর তন্ময়কে চ্যানেল আই একটি প্রস্তাব দিল, তার কার্টুন জার্নি নিয়ে একটি অ্যানিমেশন তৈরি করার। সেটি প্রচার হওয়ার পর ছড়িয়ে পড়ল অনেকের মধ্যে, আগ্রহ দেখাল অনেকজন। সেই আগ্রহ দেখে তন্ময় ভাবলেন, একটি কমিউনিটি তৈরি করার কথা– যেখানে নবীন কার্টুনিস্টরা পরস্পরের সঙ্গে ভাবনা বিনিময়ের সুযোগ পাবে।

তন্ময় নিজে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন উন্মাদ পত্রিকার মাধ্যমে, কিন্তু সবাই তো একই সুযোগ পাবে না। তাছাড়া, যদি কার্টুনকে ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে দাঁড় করাতে হয় সেখানেও বিভিন্ন কমিউনিটি ও সমমনাদের একসঙ্গে হওয়ার প্রয়োজন পড়বে। কমিউনিটির নাম রাখা হলো কার্টুন পিপল।
মজুরের বোতাম খোলা থাকে
কার্টুন পিপলের পক্ষ থেকে প্রতি সপ্তাহে 'স্কেচবুক স্যাটারডে' নামে একটি আউটডোর অ্যাক্টিভিটির আয়োজন করা হয়। কমিউনিটির ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলাকায় জড়ো হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় আগে থেকে। উদ্দেশ্য চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে যে যার মতো খেরো খাতায় আঁকো।
তন্ময়ের পর্যবেক্ষণ বলে, কার্টুনিস্ট হয়ে উঠতে হলে সবার আগে প্রয়োজন নিজের চারপাশ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আঁকার অভ্যাস করা। যেমন একজন কর্মজীবী, মানুষ ধরা যাক একজন দিন মজুর কিংবা মাছ বিক্রেতা; দেখা যায় তাদের জামার ওপরের তিনটি বোতাম সবসময় খোলাই থাকে। তার জামাটিও হয় ওভারসাইজ বা দেহের তুলনায় বড় যেন বাতাস চলাচল করতে পারে সহজে। সব মানুষেরই এরকম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। এসব দেশীয় চরিত্র পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে উঠে আসতে পারে ভবিষ্যতের দেশীয় কমিক্স কিংবা অ্যানিমেশনের কোনো ক্যারেকটার।
তাই এই চর্চা চালিয়ে যেতে একই ধারাবাহিকতায় কার্টুন পিপল থেকে তন্ময় শুরু করেন– ডিসি ডিসি ওরফে দেশি ক্যারেকটার ডিজাইন চ্যালেঞ্জ।
যেই চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিগত বছর গুলোতে সারা দেশ থেকে উঠে এসেছেন অনেক তরুণ মেধাবী কার্টুনিস্ট।

মাত্র ৩-৪ জন
স্কেচবুক স্যাটারডের কয়েক মাস সেশন চলার পর অনেকে অভিমান করল। বাড্ডায় হলে কল্যাণপুরের ছেলে-মেয়েরা বলল, 'আমরা বাদ পড়ছি কেন? আমাদের কী দোষ?' শ্যামলী, লালবাগ, দনিয়া, বনশ্রী, মালিবাগের কার্টুনিস্টদের পক্ষ থেকেও একই অভিযোগ-অনুযোগ আসা শুরু হলো। কিন্তু এভাবে এত দাবি পূরণ আসলে কি সম্ভব?
সাত-পাঁচ ভেবে তন্ময় কার্টুন পিপলের একটি ইউটিউব চ্যানেল খুললেন। সেখানে বিভিন্ন পর্বে কার্টুন আঁকার বিভিন্ন কৌশল জানাতে থাকলেন। তন্ময়ের খুশি লাগে যখন কেউ বলে তাদের শুরুটা হয়েছিল ওই ইউটিউব চ্যানেল দেখেই। তার বেশ কয়েক বছর পর শুরু করলেন কার্টুন কার্টুন নামে এক টিভি শো– যার উদ্দ্যেশ্য হল, শুধু ইন্টারনেটের মাধ্যমে না, বরং সারা দেশের ছেলে মেয়েরা যাতে বিনা পয়সায় টিভি দেখে কার্টুন আঁকা শিখতে পারে, সে ব্যবস্থা করা।
তন্ময়ের মনে পড়ে ২০১৭ সালে কার্টুন পিপল এর ইনস্টাগ্রাম থেকে বাংলা স্ট্রিপ কমিক্স প্রকাশ করা শুরু হয়। বছর শেষে যখন সবাই মিলে বেস্ট হান্ড্রেড স্ট্রিপ কমিক্স সিলেক্ট করতে বসলেন, তখন তন্ময় দেখলেন তার মধ্যে ৭ জন নারী কার্টুনিস্ট। বেশ একটু চমকে গেলেন তিনি।
কারণ তন্ময় যখন প্রথম কার্টুন আঁকা শুরু করেন ২০০৫ সালে, তখন কিংবা তার পরবর্তী ১০ বছরেও দেশে নারী কার্টুনিস্টের সংখ্যা ছিল একেবারেই হাতে গোনা ৩-৪ জন। নাসরীন সুলতানা মিতু, শিখা, সাদিয়া, জাহানারা নার্গিসের মতো নারী কার্টুনিস্টরা ছিলেন–যাদের প্রত্যকেরই শুরুটা আহসান হাবীবের অনুপ্রেরণায়, উন্মাদ পত্রিকার হাত ধরে।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার তাড়া নেই
২০১৭ থেকে ২০১৮ মাত্র এক বছরেই যখন দেখা মিললো নতুন ৭ জন নারী কার্টুনিস্টের, তখন ব্যাপারটা তন্ময়কে বেশ আগ্রহী করে তুলল। তিনি তাদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে যোগাযোগ করলেন, বুঝতে চাইলেন, নারী কার্টুনিস্টরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলনামূলক কেন বেশি অ্যাক্টিভ?
জানতে পারলেন, এক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ইমেইলে সাবমিট করার সুবিধা আসায় সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরার কোনো ব্যাপার নেই। উপকরণ বলতে প্রয়োজন কেবল একটি মোবাইল ফোন। সম্পাদকের কাছে পৌঁছানো যায় যেকোনো সময়। এটা জেনে তন্ময় ভার্চুয়াল কার্যক্রম আরো বাড়িয়ে দিলেন।
ফলাফল হলো বিস্ময়কর।
ইএমকে সেন্টারে গত ৩১ জানুয়ারি শেষ হওয়া গার্লস ডু কমিক্স নামের প্রদর্শনীর আগে যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে প্রথম পর্যায়ে ২০০ জন নারী কার্টুনিস্ট ও কমিক বুক আর্টিস্ট অংশ নিয়েছেন। সেখান থেকে প্রাথমিক বাছাইয়ে ৬০ জন মনোনয়ন পেয়েছিলেন, আর চুড়ান্ত পর্যায়ে মনোনয়ন পেয়েছেন ২৭ জন।
তন্ময় জানালেন, ঘটনাটি কেবল কার্টুন পিপলের মাধ্যমেই ঘটেনি। এখন দেশে অন্তত ৪-৫টি প্রকাশনী আছে, যারা কমিক বুক পাবলিশ করে। লাটিম নামের একটি অনলাইনে দেশী কমিক্স বিক্রির ওয়াবসাইটও আছে।
লুঙ্গি পরা সুপারহিরো
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ৮০টির কাছাকাছি কমিক বুক প্রকাশিত হয়েছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৩০-৩৫টি; ২০১০ সালের আগে এটি ছিল বছরে মোটে ১-২টি। পাঞ্জেরি, ঢাকা কমিক্স, গ্রাফিক বাংলা, রঙ্গন পাবলিকেশন, কার্টুন পিপল কমিক্স সবাই মিলে মনে হচ্ছে কমিক্সের একটি আলাদা ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে দাঁড়ানোর সময় সমাগত।
কার্টুন পিপল মনে করে দেশি-বিদেশি মারভেল, ডিসি কিংবা মাঙ্গা– সকল কমিক্সকে আমাদের স্বাগত করা উচিত, তাদের থেকে শেখা উচিত; তবে সবকিছু দেখে পড়ে আমাদের নিজেদের একটা ভয়েস থাকা খুব জরুরি।

তন্ময় রুস্তম পালোয়ান নামে যে কমিক বুক সিরিজ আকারে প্রকাশ করে চলেছেন, তাতে রূপকথার রাক্ষস-খোক্কস বা ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর গল্পকে নতুন করে নতুন জেনারেশনের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে, সম্পূর্ণ নতুন সময়ের দাবিকে সামনে রেখে। এখানে রুস্তম লুঙ্গি কাছা মেরে ভুত-পেত্নি তাড়া করে। সে বাংলার রূপকথার দুনিয়ার যেন এক সুপারহিরো। নতুনদের কাছেও তার দাবি, তারা যেন নিজেদের মতো করে সবার জন্য আঁকেন। জাপানিরা নিজেদের মতো করেই মাঙ্গা এঁকেছেন, এখন তা সারা পৃথিবীর আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
গার্লস ডু কমিক্স ও পলিটিক্যাল কার্টুন
তন্ময় আরও একটু যোগ করলেন, "কার্টুন বলতে আমরা পলিটিক্যাল কার্টুনই বুঝেছি বিশেষ করে শিশির ভট্টাচার্য ও আসিফুল হুদার কার্টুনের মাধ্যমে। রনবীর টোকাইও কিন্তু হাইলি পলিটিক্যাল কার্টুন, আর সেটা সোসিওপলিটিক্যালও।"
তিনি বলেন, "গার্লস ডু কমিক্স নামে আমরা যে কমিক্স প্রদর্শনীর আয়োজন করলাম, তাও কিন্তু বেশ পলিটিক্যাল এবং সেটি এক ধরনের আইডেনটিটি পলিটিকস। নারীরা তাদের নিজের পরিচয়কে তুলে ধরছেন, এ পরিচয় তারা নিজেদের মত তুলে ধরতে পারলে তারা নিজের মতো বাঁচতে পারবেন, আর এটুকু অধিকার তো সকল মানুষেরই থাকা উচিত।"
এই নতুন একদল তরুণ নারী কার্টুনিস্টদের সঙ্গে এতদিন দেখা হয়নি বলে অর্ধেক কথাই জানা হয়নি বলে উল্লেখ করেন তন্ময়। মজার ব্যাপার হলো, যখন গার্লস ডু কমিক্সে তন্ময় তাদের ওয়ার্কশপ পরিচালনা করতে গেলেন তখনই দ্বিধায় পড়লেন, কারণ তার দৃষ্টিকোণ তো একজন পুরুষের।
তন্ময় বলেন, "একজন পুরুষ হয়ে আমি কি মেয়েদের কাজকে সঠিকভাবে বুঝতে অথবা সম্পাদনা করতে প্রস্তুত? তবে এক্ষেত্রে আমাদের দারুণ সহায়তা দিয়েছেন উন্নয়ন ও সংস্কৃতিকর্মী ওয়ারদা আশরাফ। তিনি আমাদের অসম্পূর্ণতাগুলো পূরণ করতে সাহায্য করেছেন। আমরা আশা করি, গার্লস ডু কমিক্সের পরবর্তী বছরগুলোতে আরও অনেক নারী আমাদের এই কাজে যুক্ত হবেন।"
ছবি সৌজন্য: রাশাদ ইমাম তন্ময়/কার্টুন পিপল