অনেক পরিবর্তন দেখেছেন আমানুল্লাহ: চোখের সামনে কত কী ঘটে গেল!
তিয়াত্তরে ঢাকায় আসেন আমানুল্লাহ। গুলিস্তান সিনেমা হলের ধারের সড়কদ্বীপে তখন শহরের শোভা বাড়াত মীর জুমলার কামান বিবি মরিয়ম। কামানের কাছে দাঁড়িয়ে সেদিন ২১ বছর বয়সী আমানুল্লাহর কান্না পেয়েছিল। অচিন এক জায়গা। চারদিকে ভীড়, গাড়ির হল্লা। অথচ মনোহরদীতে তাঁদের বাড়িটি ছায়াশীতল। চার কিলোমিটার দূরে বাজারে গেলে কিছু ভিড় দেখা যেত। নয়তো মিহি বাতাসের শিস আর ঝরা পাতার টুপটাপ ছাড়া আর হল্লা কোথায় আমানুল্লাহর গাঁয়ে।
বাবার সঙ্গে বন্দে (চকমিলানো জায়গা) কাজ করতে যেতেন আমানুল্লাহ ভোরবেলায়। পরের জমিতে বর্গাচাষি ছিলেন বাবা। তিন ভাইবোনের মধ্যে আমানুল্লাহ সবার বড়। যখন বন্দে কাজ থাকত কম, তখন মোট (বস্তা) বাইতেন। মাথায় করে চার কিলোমিটার দূরের বাজারে মোট নিয়ে গেলে ২৫ পয়সা। দিনে চারবার মোট বাইতে পারলে ১ টাকা জমত হাতে। তখন চাউলের সের ছিল ১০ থেকে ১২ আনা (এক টাকা=১৬ আনা)।
তবে স্কুলে পড়ারও সুযোগ হয়েছিল তার ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। পেপার তিনি পড়তে পারেন—আর এখনও পড়েন প্রতিদিন। দুর্ঘটনা, বিচিত্র সংবাদ, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর হুমকি-ধমকি, যুদ্ধ ইত্যাদি খবর তাকে আকৃষ্ট করে। ঢাকায় তার এক ফুপাতো ভাই থাকত।
'ওইসব সময়ে মানুষের ব্যবহার ছিল খারাপ। চড়-থাপ্পর মারত। লাফ দিয়া রিকশায় উইঠা কইত, ওই ব্যাটা চল। কই যাইবেন? জিগাইলে চেইতা যাইত। এক জায়গায় দাঁড় করায়া রাইখা বন্ধু-বান্ধবের লগে আড্ডা দিত। কেউ কেউ তো এই আইতাছি কইয়া ভাড়া না দিয়া পলাইত।'
যুদ্ধের পরের দেশ (তিয়াত্তর সাল), গ্রামে কোনো কাজকর্ম নেই, তাই ঢাকায় আসা আমানউল্লাহর। যুদ্ধ লাগার আগে আগে তিনিও মিছিলে গেছেন, স্লোগান দিয়েছেন—'ইয়াহিয়া-ভুট্টো দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই'। যুদ্ধের সময় গ্রামেই ছিলেন, মাঝেমধ্যে দৌড়ে পালিয়েছেন। লুট করার তালে থাকত যারা, তারা হঠাৎ হঠাৎই আওয়াজ দিত, 'ওই মিলিটারি আইল, ওই আইল'। আর তাতে দৌড়াদৌড়ি লেগে যেত। খাওয়া-খাদ্যি কিছু মিলত না বাজারে, একবার টানা তিন দিন পানি ছাড়া আর কিছু পাননি, তখন নারকেল পাতা ভিজিয়ে নরম করে খেয়েছেন।
ঢাকায় এসে প্রথম কয়েকদিন একটা মুদির দোকানে চাকরি করেছেন। থাকতেন মধ্যবাড্ডায়। রামপুরায় ছিল কাঠের ব্রিজ। এখনকার মৌচাক থেকে মধ্যবাড্ডা, পুরো পথটাই ছিল কাঁচা। রামপুরার খাল দিয়ে ছোট ছোট লঞ্চও চলত। ব্রিজের তলা দিয়ে গুদারাও ছিল। রামপুরার পরে ঘর-বাড়ি ছিল দূরে দূরে, অল্প অল্প, গ্রামের মতো ছিল চেহারা।
আর আমানুল্লাহর কপাল মন্দ, যে মুদিখানায় কাজ করতেন সেটি বন্ধ হয়ে গেল। তাই উপায় না পেয়ে গেলেন জুলহাস মোল্লার গ্যারেজে। সেটি ছিল মগবাজারের গাবতলায়। ১০-১২টি রিকশা ছিল মোল্লার। একটি চালানোর সুযোগ পেলেন আমানুল্লাহ। দিনে জমা দিতে হতো ৫ টাকা।
আমানুল্লাহর মনে আছে, মধ্যবাড্ডা থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে একবার ভাড়া পেয়েছিলেন ৬ টাকা। তখনো গুলিস্তানের পর সিদ্দিকবাজার-নয়াবাজার রাস্তাটি ছিল চিপা (সরু)। রিকশা নিয়ে যেত হতো নবাবপুরের মধ্য দিয়ে। তখন চালের সের তিন টাকায় উঠেছে। সম্ভবত ১৯৮০ সাল।
সে সময় পিচঢালা ভালো রাস্তা ছিল ময়মনসিংহ রোড—শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, মহাখালী হয়ে নতুন বিমানবন্দর। আর ঢাকার কেন্দ্র ছিল গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট। ফুলবাড়িয়া তখনও নামকরা জায়গা। মৌচাক থেকে রাজারবাগ হয়ে আরামবাগের রাস্তাও ভালো ছিল। তবে মতিঝিলের পথ ছিল কাঁচা। জহুরুল ইসলামের বিল্ডিংটা ছিল উঁচু আর সবই ছিল চার-পাঁচতলা বা তার চেয়ে কম উচু। মধুমিতা সিনেমা হল আর ইত্তেফাকের মোড় ছিল অনেক জমজমাট। এরপর টিকাটুলি পার হয়ে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি ছিল।
কাঠবডি মুড়ির টিন দেখেছেন আর তাতে চড়েওছেন আমানুল্লাহ। এই গাড়িটাই সারাদেশে চলত। ঢাকায় চলত গুলিস্তান থেকে মহাখালী হয়ে গুলশান।
জানতে চাইলাম: এখন কেমন মানুষের আচার-ব্যবহার? আমানুল্লাহ বললেন: অনেক ভালো। মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ছে। রিকশাওয়ালা বইলা অসম্মান করে না, আর করলেও কম। আগের দিনে তো আমাগো মানুষই মনে করত না।
আশির দশকেও চার আনার দাম ছিল। আমানুল্লাহ বললেন, 'সারাদিনে জমা বাদ দিয়ে ৬-৭টাকা থাকত। তখন চার আনা (পঁচিশ পয়সা) দিয়ে পুরী পাওয়া যেত। চায়ের দোকান মোড়ে মোড়ে আছিল না। পুরা শহরেই লোক ছিল কম। নব্বই সালে একবার রিকশা গোনা হইছিল—শুনছিলাম রিকশার সংখ্যা ৮০ হাজার।
'ওইসব সময়ে মানুষের ব্যবহার ছিল খারাপ। চড়-থাপ্পর মারত। লাফ দিয়া রিকশায় উইঠা কইত, ওই ব্যাটা চল। কই যাইবেন? জিগাইলে চেইতা যাইত। এক জায়গায় দাঁড় করায়া রাইখা বন্ধু-বান্ধবের লগে আড্ডা দিত। কেউ কেউ তো এই আইতাছি কইয়া ভাড়া না দিয়া পলাইত।'
জানতে চাইলাম: এখন কেমন মানুষের আচার-ব্যবহার?
আমানুল্লাহ: অনেক ভালো। মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ছে। রিকশাওয়ালা বইলা অসম্মান করে না, আর করলেও কম। আগের দিনে তো আমাগো মানুষই মনে করত না।
লেখক: ঢাকা শহরে চলে ফিরে আরাম পাইছেন কোনো সময়?
আমানুল্লাহ: ধরেন বিশ বছর আগে। তখন যানজটও বেশি ছিল না আর মানুষের আচার-ব্যবহারও নরম হয়া আসছিল। টাকা পয়সারও আমদানি ছিল।
লেখক: কিছু সঞ্চয় করতে পারেন নাই?
আমানুল্লাহ: কেমনে পারুম? আমি একলা কামাইসুদ (রোজগেরে)।
লেখক: পঞ্চাশ বছর ধরে রিকশা চালান। শহরটা কেমন দেখলেন?
আমানুল্লাহ: উন্নত হইছে। শহর আগের চেয়ে অনেক উন্নত হইছে মানে রাস্তা-ঘাটের দিক দিয়া। তয় মানুষও বাড়ছে। যত রাস্তা হইছে মানুষ বাড়ছে তার তিন-চারগুণ। আগে ফুলবাড়ি, কমলাপুর, আনন্দ সিনেমা হল এরকম হাতেগোনা স্টেশন ছিল । এখন তো পাড়া-মহল্লায়ও গাড়ি চলে। হিসাব করলে হাজার হাজার স্টেশন এহন ঢাকা শহরে।
লেখক: এই যে এত চানাচুর, বিস্কুট, চকলেট, টিস্যু পেপার, নুডলস, পাস্তা কত কিছু দেখলেন দিনে দিনে, আগে তাহলে কীভাবে চলত?
আমানুল্লাহ: দরকার আছিল না। এত কিছু মানুষ চিনতও না, চাহিদাও আছিল কম। মানুষ এক বেলা রানত, তিনবেলা খাইত। লাকড়ির চুলায় রান্না-বান্না হইত। ছোটবেলায় আমরা সরিষার তেল কিনতাম, সয়াবিন দেখিও নাই। তখন ওজনের মাপ ছিল ছটাক, দেড় ছটাক এমন। ইলিশ মাছের তেল দিয়া আরো শাক-সবজি রান্না হয়া যাইত। মাছ পাওয়া যাইত অনেক। পুকুর-খালে ঝাঁকি জাল ফেললে ডুলা (বাঁশের ঝুড়ি) ভইরা মাছ নিয়া বাড়ি যাইতাম। অনেক শাক-সবজির ফলন হইত। আশি-পঁচাশি সালে মানুষ সন্ধ্যার পর একলা পরীবাগ পার হইতে ভয় পাইত। বিশ-বাইশ বছর আগেও আমরা রিকশা চালাইতাম হারিকেন দিয়া। আট আনার কেরোসিন তেল কিনলে সারা রাত হারিকেন জ্বালাইয়া রাখতে পারতাম। আর এহন কেরোসিন তেল মুদির দোকানে বিচরাইয়া (খুঁজে) পাইতে কষ্ট হয়।
লেখক: আপনার পান-তামাকের খরচ কেমন?
আমানুল্লাহ: আমার বিড়ি খাওয়ার নেশা ছিল। সেটা হইছে কেমনে? হাসির কথা। তখন দুই-চার বাড়িতেও একটা ম্যাচ পাওয়া যাইত না, ছোটবেলার কথা বলতাছি। বাবা বন্দের থেকে বাড়িতে পাঠাইত হুক্কা জ্বালাইয়া আনতে। হুক্কায় টিকা থাকত, টিকায় আগুন দেওয়া হইত। সেই আগুন জিয়াইয়া (জ্বালাইয়া) রাখনের জন্য ফুয়াইয়া ফুয়াইয়া নিয়া যাইতে হইত। এমনে ফুয়াইতে ফুয়াইতে নিশা লাইগা গেল। ঢাকা আইসা পরে বিড়ি ধরলাম।
লেখক: মোবাইল ফোন ব্যবহার করা শুরু করলেন কবে থেকে?
আমানুল্লাহ: দশ বছর আগে থেকে। মেজো মেয়ের তখনো বিয়ে হয়নি। আমি জানতাম না, ঢাকায় এসে সে গার্মেন্টে কাজ নিছে। আমারে একদিন একটা মোবাইল হাতে দিয়া বলল, এইটা রাখো, বাড়িতে কথা কইবা। আমি বেকুব বনলাম, কইলাম, দাম কত? মেয়ে বলে, দাম দিয়া কাম কী? কথা কইবা, সবার খোঁজ-খবর রাখবা, নিজের বিপদ-আপদের খবর দিবা, রাখো। আমি লুঙ্গি ফিন্দি (পরি) সারা বছর। লুঙ্গির কোঁচড়েই রাখি মোবাইল।
তিন মেয়ে আমানুল্লাহর
১৯৮৫ সালে বিয়ে করেছেন আমানুল্লাহ। প্রথম মেয়ের জন্ম '৮৮ সালে। তারপর আরো দুইজন। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় মেয়ের স্বামী গ্রামে গেরস্তি করে। মেজো মেয়ের স্বামী ২০২০ সালে সৌদি আরব গিয়ে করোনায় পড়েছেন। পালিয়ে পালিয়ে থাকেন। আকামা (কাজের অনুমতিপত্র) হয়নি এখনো।
মেজো মেয়ের ঘরে দুটি নাতনি আছে। ছোট মেয়ে মোহাম্মদপুরে নার্সিং কলেজে পড়ে। ছেলেসন্তান নেই কোনো আমানুল্লাহর। মগবাজারের নয়াটোলায় মেসে থাকেন। স্ত্রী বাড়িতেই থাকেন।
আমানুল্লাহ খাওয়া-দাওয়া করেন রাস্তা-ঘাটে। বাড়িতে যান বছরে দুই বা তিনবার। গত বছর বেশ কিছুদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ছিলেন। তখন জানা যায়, তার অন্ননালী শুকিয়ে গেছে। তাই এখন জাউ, দুধ খান বেশি। শক্ত খাবার খেতে পারেন না।
এত কিছু মানুষ চিনতও না, চাহিদাও আছিল কম। মানুষ এক বেলা রানত, তিনবেলা খাইত। লাকড়ির চুলায় রান্না-বান্না হইত। ছোটবেলায় আমরা সরিষার তেল কিনতাম, সয়াবিন দেখিও নাই। তখন ওজনের মাপ ছিল ছটাক, দেড় ছটাক এমন। ইলিশ মাছের তেল দিয়া আরো শাক সবজি রান্না হয়া যাইত। মাছ পাওয়া যাইত অনেক। পুকুর-খালে ঝাঁকি জাল ফেললে ডুলা (বাঁশের ঝুড়ি) ভইরা মাছ নিয়া বাড়ি যাইতাম। অনেক শাক-সবজির ফলন হইত। আশি-পঁচাশি সালে মানুষ সন্ধ্যার পর একলা পরীবাগ পার হইতে ভয় পাইত। বিশ-বাইশ বছর আগেও আমরা রিকশা চালাইতাম হারিকেন দিয়া। আট আনার কেরোসিন তেল কিনলে সারা রাত হারিকেন জ্বালাইয়া রাখতে পারতাম। আর এহন কেরোসিন তেল মুদির দোকানে বিচরাইয়া (খুঁজে) পাইতে কষ্ট হয়।
এখন দিনে তিন-চার ঘণ্টা গাড়ি চালান, তা-ও সপ্তাহে দু-তিনদিন মাত্র। অথচ এমন দিন গেছে মাসে একদিনও ছুটি নেননি।
বাবার থেকে তিন শতাংশ জমি পেয়েছেন, তাতে দুই ঘরের একটি টিনের বাড়ি আছে। এছাড়া আর কোনো জমি-জিরাত নেই।
গোটা সত্তর বছরের মধ্যে ৫০ বছরই রিকশা চালালেন আমানুল্লাহ। কোনো সঞ্চয় নেই, জায়গা-জমি নেই। উপায় কী রিকশা না চালিয়ে?
জানতে চাইলাম, মাসে এখন কত খরচ আছে আপনার?
আমানুল্লাহ্: আমার নিজের খরচ পাঁচ হাজার টাকা, বাড়িতে পাঠাই তিন হাজার টাকা আর ছোট মেয়েটারে কিছু কিছু দেই। এছাড়া মোবাইল-টোবাইল মিলিয়ে টুকিটাকি আরো কিছু খরচ আছে। সব মিলায়া ধরেন দশ হাজার টাকা। এই টাকাটা লাগেই মাসে। যতদিন বাঁইচা থাকব, খরচ করাই লাগবে, ইনকামও করা লাগবে। আল্লাহ আমারে এখনো ভালোই রাখছে। চোখে ভালো দেখি, ডায়াবেটিস নাই। খালি কানে একটু কম শুনি আর শক্ত কিছু খাইতে পারি না।
লেখক: আপনার পছন্দের খাবার কী?
আমানুল্লাহ: ইলিশ মাছ।
লেখক: বেড়াইতে গেছেন কোথাও? মানে ঢাকা, নরসিংদীর বাইরে আর কোথাও গেছেন?
আমানুল্লাহ: কুমিল্লা, টাঙ্গাইল আর মানিকগঞ্জ গেছি।
লেখক: আপনার স্বপ্ন কী?
আমানুল্লাহ: নাতি-নাতকর নিয়া খাইয়া-লইয়া বাঁইচা থাকাই স্বপ্ন। বেশি কোনো স্বপ্ন নাই আর।
