নতুন সম্পর্কে জড়াতে আগ্রহী মেলিন্ডা গেটস, মূল চারটি বিষয় জানালেন!

২০২১ সালের আলোচিত একটি বিষয় ছিল মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, বিলিয়নিয়ার ধনকুবের বিল গেটস ও তার স্ত্রী মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটসের বিবাহবিচ্ছেদ। দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন ও সম্পর্কের অবনতির কথা তখন উঠে এসেছিল গণমাধ্যমে। বিচ্ছেদের পর এই জুটির সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়েও কম চর্চা হয়নি। তবে সরাসরি জনসমক্ষে নিজের বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে এতদিন কথা বলেননি মেলিন্ডা। কিন্তু সম্প্রতি এই জনহিতৈষী ফরচুন ম্যাগাজিনকে জানিয়েছেন, একটি সম্পর্কে কিভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে হবে তার নতুন নতুন উপায় আবিষ্কার করছেন তিনি। সেই সাথে ভবিষ্যতে নতুন রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ানোর আগ্রহ রয়েছেন বলেও জানান ৫৮ বছর বয়সী এই বিলিয়নিয়ার।
গত সপ্তাহে ক্যালিফোর্নিয়ায় 'ফরচুন'স মোস্ট পাওয়ারফুল উইমেন সামিট'-এ মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটস জানান, বিল গেটসের সাথে বিচ্ছেদের পরবর্তী সময়টা ভয়াবহ যন্ত্রণায় কাটিয়েছেন তিনি। কিন্তু ভবিষ্যতে পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবন- দুটি ক্ষেত্রেই তিনি কোন ধরনের সম্পর্কে জড়াবেন, তা নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করছেন তিনি। আর এক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনাকে আরও শাণিয়ে নিতে বিখ্যাত সাইকোথেরাপিস্ট ও লেখক এস্থার পেরেলের কাছে 'রিলেশনাল ইন্টেলিজেন্স' এর ওপর মাস্টারক্লাস সম্পন্ন করেছেন তিনি।

ফরচুনের সামিটে মানবজীবনের নানা ধরনের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন মেলিন্ডা। তিনি বলেন, "পেরেল একটা বিষয়ের কথা বলে, তা হচ্ছে ক্ষমতা। কর্মক্ষেত্রে এখনো আমার প্রাক্তন স্বামীর সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে এবং আমি আশা করছি কর্মক্ষেত্রের বাইরেও কারো সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠবে।কিন্তু একটি সম্পর্কের গভীরে যে ক্ষমতা থাকে তা আমাদের বুঝতে হবে এবং সেটি কিভাবে দুজনে মিলেমিশে শেয়ার করবো তা ভাবতে হবে।"
মেলিন্ডার ভাষ্যে, মাস্টারক্লাসে পেরোল আরও উল্লেখ করেছেন যে, সম্পর্কের মধ্যে যে সহজাত ক্ষমতা থাকে সেটি সরিয়ে দেওয়া নয়, বরং দুজনে মিলে সেই ক্ষমতা আরও জোরদার করার চেষ্টা করতে হবে।
পেরোলের মাস্টারক্লাস শেষ করার পর মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা ও সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখার নতুন নতুন পদ্ধতি ও কলাকৌশল জানতে পেরেছেন মেলিন্ডা গেটস এবং তারই ভিত্তিতে সামিটে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের ৪টি উপদেশ দিয়েছেন।
১. একক নয়, যৌথ ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করা
আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কে সবসময়ই যে প্রশ্নক্টি সামনে চলে আসে তা হলো- 'ক্ষমতা দেখানো' নাকি 'ক্ষমতা তৈরি করা'? সাইকোথেরাপিস্ট এস্থার পেরেল বলছেন, শেষোক্ত বিষয়টির চর্চা করলে অনেক বেশি সক্রিয় থাকা যায়। সাধারণত, আমাদের ধারণা যে কোনো জুটির মধ্যে যিনি আয় করবেন এবং সংসারের খরচ চালাবেন, তিনিই 'বস' হয়ে দাঁড়াবেন এবং তিনিই সকল ক্ষমতার অধিকারী হবেন।

কিন্তু পেরেল এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বলছেন, একক ক্ষমতার চর্চা না করে বরং যার হাতে বেশি সুযোগ বা সম্পদ থাকবে সে অপর সঙ্গীকে নিজের মতো করে সময় কাটানোর বা তার নিজস্ব কাজগুলো করার পথ তৈরি করে দিবে। যেমন- অপর সঙ্গী চাইলে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করা বা নিজের কোনো পছন্দের ক্লাস বা কোর্স করার পেছনে সময় ব্যয় করতে পারে। এতে করে দুজনের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া তৈরি হবে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হবে।
একসময় মনে করা হতো, আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কে ক্ষমতা একেবারে 'নির্ধারিত' একটি বিষয়। কিন্তু আসলে তা নয়, ক্ষমতা অনেকটা 'তরল' একটি বিষয় এবং সমঝোতার মাধ্যমে এতে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
পেরেল বলেন, "আমার কাছে ক্ষমতা আছে কিনা সেটা আসল কথা না। প্রশ্ন হচ্ছে, আমার সেই 'কর্তৃত্ব' আছে কী? আমি কি নিজে আলাদাভাবে কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নিতে পারি?" বিষয়টি ব্যাখ্যা করে পেরেল বলেন, একজন মানুষের কাছে টাকা না থাকলেও তার কাছে কর্তৃত্ব থাকতে পারে এবং সে সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে।

ক্ষমতার বিবর্তন হয় এবং একবার আমরা এটি বুঝতে পারলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, ক্ষমতা একেবারে চূড়া থেকেও উৎসারিত হতে পারে, আবার তলানি থেকেও আসতে পারে। এটা কর্মক্ষেত্রেও হতে পারে, আবার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দুজন সঙ্গীর কারো কাছে যদি ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে সে অপরজনের উপর আধিপত্য বিস্তারের চাইতে তাকে সব ক্ষেত্রে উৎসাহ দিতে পারলে সেই সম্পর্ক সুন্দর হয়।
২. বিশ্বাস স্থাপন করতে ঝুঁকি নেওয়া
লেখক পেরেল মনে করেন, সম্পর্কের মধ্যে কিছু 'ছোটখাট' ঝুঁকি নিলে সঙ্গীর সাথে বিশ্বাস স্থাপন করা সহজ হয়। এই যেমন- সম্পর্কে থাকাকালীন সঙ্গীর এমন কোনো অনুরোধে বা প্রস্তাবে 'হ্যাঁ' বলা, কিংবা তার সাথে এমন কিছু শেয়ার করা যা সাধারণত আপনি করেন না। এ কাজগুলোর মাধ্যমে অপরপক্ষ আপনার উপর ভরসা রাখতে শুরু করবে।

তবে সম্পর্কে থাকাকালীন প্রায়ই দেখা যায় দুজনের কেউ একজন ভাবছে যে সে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে। এই অনুভূতি থেকে সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটতে পারে। কিন্তু পেরেল মনে করেন, এই 'ভাঙন'গুলো মেরামত করে ফেলা সম্ভব; ঠিক যেমন একটা প্লেট ভেঙে গেলেও তা জোড়া লাগানো সম্ভব, যদিও জোড়া লাগানোর ফলে সেটি দেখতে ভিন্নরকম লাগবে। কিন্তু এই ভাঙনের পুনরাবৃত্তি হলে কিন্তু সমস্যা!
৩. পক্ষপাতী আচরণ না করা
কখনো কখনো আমরা একজন ব্যক্তিকে কিছু নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে ফেলি, আমরা ধরেই নেই যে সে কিছু নির্দিষ্ট আচরণই করবে। এমনকি কাউকে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ না দিয়েই ধরে নেই যে সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে!
কিন্তু কারো উপর নির্দিষ্ট কিছু প্রত্যাশা করে বসে থাকলে তার প্রতি সমানুভূতি আনা এবং সঙ্গী হিসেবে তার ভূমিকা বুঝতে পারার ক্ষমতা কমে যায়, আমরা বন্দী হয়ে পড়ি একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। এ ধরনের প্রবণতা কমানোর উপায় হচ্ছে, অপরজনের ব্যাপারে কৌতূহল দেখানো এবং তাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা যে সে ঠিক কোন পরিস্থিতি থেকে উঠে এসেছে। যেমন- কেউ যদি তার পিতামাতার একমাত্র সন্তান হিসেবে এবং অপর সঙ্গী যদি পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে বড় হয়ে থাকে, তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে কারো ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হবে। অর্থাৎ, 'পরিস্থিতি' এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।
৪. আত্মসচেতনতা দেখানো
একটি নতুন সম্পর্কে যাওয়ার বেলায় আমরা সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থায় থাকবো এমনটা বিশ্বাস করা অনেকটা 'ধোঁকা'র মতো- যদিও সবাই সেটিই চায়। আমাদের নিত্যদিনের জীবনাচরণের উপর ভিত্তি করেই প্রতীয়মান হয় নতুন একটি সম্পর্কে আমরা নিজেদের কিভাবে উপস্থাপন করবো। তাই আত্মসচেতনতা হচ্ছে 'রিলেশনাল ইন্টেলিজেন্স' এর সর্বপ্রথম ধাপ। দুজন ব্যক্তি যদি একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে নিজেদের সমস্যাগুলো শেয়ার করে এবং সমাধানের উপায় খোঁজে তাহলে দুজনের মধ্যে প্রকৃত যোগসূত্র তৈরি হয়।

একসময় মানুষের আবেগ খুব সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যেত। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তিগত ল্যান্ডস্কেপ দ্বারা মৌলিকভাবে পরিবর্তিত একটি বিশ্বে আবেগকে আড়াল করা সম্ভব। তাই মানসিক ও সম্পর্কীয় বুদ্ধিমত্তাকে (রিলেশনাল ইন্টেলিজেন্স) একসময় অন্যান্য মৌলিক দক্ষতার অধীনস্থ হিসাবে দেখা হলেও, এখন সাফল্য অর্জনের জন্য এগুলো অপরিহার্য বলে মনে করা হয়।
আর মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটসকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, কিভাবে তিনি একটি মাল্টিবিলিয়ন ডলারের সংস্থার সহ-চেয়ারপারসন হিসেবে তার প্রাক্তন স্বামীর সাথে কাজ করছেন, তখন মেলিন্ডা বলেন, "আমি যা শিখেছি তা হলো- সব জায়গায় নিজের প্রকৃত সত্ত্বাকেই প্রকাশ করা এবং এটাই আমি সবসময় চেয়েছি।"
সূত্র: ফরচুন