বাবাকে লেখা চিঠি: ‘কাফকায়েস্ক’ পবিত্র আত্মার আর্তচিৎকার

'কেন আমার সন্তান এত কুৎসিত হল। চারপাশে কত সুন্দর শিশু। লাবণ্যও কত সুন্দর। নিশ্চয় আমার স্বামীত্বের জন্যই। পৃথিবীর আজব কিসসা ও রহস্য।'
ডায়েরিতে লেখা জীবনানন্দ দাশের এই কথাগুলো তিরের মতো তীব্রভাবে বেঁধে। একবার পড়ার পর আবার পড়ি, কয়েকবার পড়ি। সম্পর্কের নিক্তিতে ফেলে কিংবা সম্পর্কের নিক্তির বাইরে রেখেও লাইনগুলো পড়ি। এক অন্ধকার টানেলের ভেতর ঢুকে পড়ি। ঝিম মেরে ভাবি, এ-ও হয় নাকি! হয়েছে তো! কত শতবার পৃথিবীর বুকে এমন ঝড় উঠেছে। সম্পর্ক গিয়ে ঠেকেছে খাদের কিনারায়। আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। পারে না! তবুও কত মহত্ত¡ আর দেবত্বের ভার নিয়ে যে সম্পর্কগুলো দাঁড়িয়ে থাকে! সে ভারের কোনো ভারসাম্য থাকে না, সারাক্ষণই যেন এক দিকে হেলে থাকে। সবাই যদিও জানে কিন্তু কেউ বলে না। এরপরও কেউ কেউ সেই ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দিয়ে লিখে বসেন, 'যা আমার প্রয়োজন ছিল, তা হলো একটু উৎসাহ, খানিকটা আন্তরিক ব্যবহার, আমার পথ খানিকটা খোলা রাখার চেষ্টা। তার বদলে আপনি সেই পথ রুদ্ধ করে দিলেন, যদিও উদ্দেশ্য ছিল আমাকে অন্য কোনো পথে চালিত করা। কিন্তু আমি সে পথে হাঁটার যোগ্য ছিলাম না...তখন সব দিক থেকে আমার দরকার ছিল উৎসাহ।'
অন্য কেউ নন, পৃথিবীর মহান লেখকদের অন্যতম ফ্রানৎস কাফকার এই যে আক্ষেপ, তার কেন্দ্রে ছিলেন স্বয়ং নিজের বাবা। কাফকাকে প্রথম চিনেছিলাম তার 'মেটামরফোসিস' বা 'রূপান্তর' দিয়ে। এই বইয়ের শুরুর কয়েক লাইন পড়ার পর 'নিঃসঙ্গতার এক শ বছর'র লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস নাকি বিছানা থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। এতটাই ধাক্কা খেয়েছিলেন! বিছানা থেকে পড়ে না গেলেও এমন ধাক্কা সম্ভবত কাফকা পাঠকদের সবাই খেয়েছিলেন। ঘুম থেকে জেগে উঠে গ্রেগর সামসার নিজেকে পোকা হিসেবে আবিষ্কার করার ঘটনা শুধু আপনার অস্তিত্ব ধরেই টান দেবে এমন নয়, এটি বহুদিন পর্যন্ত আপনার ঘুম থেকে জেগে ওঠাকে ঠেলে দিতে পারে ব্যাপকতর এক আতঙ্কের দিকে। তবে এটা শুধুই একটামাত্র উপলব্ধি। এর বাইরেও 'যদি' 'কিন্তু' থেকেই যায়।
ব্যক্তি মানুষের একটা ভাবনা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। চিন্তাও কখনো আকাশ থেকে টুপ করে মাথায় ভেতর পড়ে না। ধারাবাহিকভাবে ধাপে ধাপে অভিজ্ঞতার ভেতর সেটা একজনের ভেতর সঞ্চিত হতে থাকে; যা শেষ পর্যন্ত মিশে যায় ব্যক্তির সহজাত ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের সঙ্গে। আর দুই এর মিশ্রণে তৈরি হয় স্বতন্ত্র এক চিন্তা। যে চিন্তার বিস্ফোরণে আমরা পাই মানুষের নিজেকে পোকা হিসেবে আবিষ্কারের দৃশ্য। কাফকার এই অস্তিত্বের সংকট এটা একেবারেই তাঁর সহজাত এবং স্বতন্ত্রও বটে। কিন্তু এর পেছনে যেসব অভিজ্ঞতা বা ঘটনা প্রভাব রেখেছে, তা আশপাশের পরিবেশজাত। বাবাকে লেখা কাফকার চিঠি পড়লে এই অভিজ্ঞতা ও ঘটনার চিত্রটা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। এই চিঠি সাধারণ কোনো চিঠি নয়। একজন ব্যক্তি মানুষের সংকট, নিজেকে অবাঞ্চিত অনুভব করা, গ্লানি আর অপমানের যে তীব্রতা, সেটা বারবার উঠে এসেছে এই চিঠিতে। আর এসবের যুক্ত করা যেতে পারে জমতে জমতে পাহাড় হয়ে যাওয়া অভিমানকেও; যা কখনো কাফকাকে থিতু হতে দেয়নি।
শিশুমন একটা সাদা কাগজ। ধীরে ধীরে তার ওপর রং পড়তে থাকে। যে ধরনের রং পড়বে, সেভাবেই তার চেতনা গড়ে উঠবে। তবে কিছু কিছু তুলি এমন থাকে, যার স্ট্রোক অনেক গভীর হয়। সামান্যতেই তা বিশাল এক ছাপ রেখে যায়। সাধারণত বাবা, মা, ভাই, বোন এইসব কাছের মানুষেরাই সেই তুলি হাতে অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু বাবার হাতে থাকা তুলিতে কাফকার মনে ধূসর রং ছাড়া আর কোনো রঙের স্ট্রোকই পড়েনি। আর সেই রংই আমৃত্যু তাড়া করে গেছে তাকে। একজন জীবন্ত মানুষকে প্রথমে জীবন্মৃত করে রেখেছে, তারপর আক্ষরিক অর্থে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর দিকে।

প্রাপ্তবয়স্ক কাফকার মধ্যে তৈরি হওয়া বিপন্নতা, অসহায়তা, সদা আতঙ্কগ্রস্ত থাকা এবং অস্তিত্বহীনতার যে বোধ, তার পুরোটাই 'কর্তৃত্ববাদী' বাবার আচরণের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সৃষ্ট। চিন্তার দিক থেকে কাফকা কতটা অসাড় হয়ে পড়েছিলেন, তা বোঝা যায় এই কথাগুলোয়, 'এই সব ভাবনাকে বাইরে থেকে যতই স্বাধীন মনে হোক, শুরু থেকেই সেগুলোর ওপর আপনার অবমূল্যায়ন ও তাচ্ছিল্যের বোঝা চেপে বসেছিল। এমন পরিস্থিতিতে কোনো চিন্তাকে পূর্ণতা ও স্থায়িত্বসহকারে গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব ছিল।'
বাবার কাছ থেকে পাওয়া এই আচরণ শৈশবেই কাফকাকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল; যা তার মধ্যে তৈরি করে চিরকালীন এক উদ্বেগের। এই উদ্বেগ বা ফোবিয়া কাফকাকে আমৃত্যু তাড়া করেছে। সারাক্ষণ দড়িকে সাপ ভাবার মতো আঁতকে ওঠার অনুভ'তি দিয়ে গেছে। চিঠিতে কাফকা লিখছেন, 'কোনো কিছু নিয়ে উচ্ছ¡সিত হওয়া, উচ্ছ্বাসে মন ভরে যাওয়া, ঘরে ফিরে সেসব নিয়ে কথা বলা–এটুকুই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উত্তরে মিলত একটি বিদ্রুপময় দীর্ঘনিশ্বাস, মাথা নাড়ানো, টেবিলে আঙুল ঠোকানো… নিশ্চয়, আপনি যখন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন, প্রতিটি শিশুসুলভ তুচ্ছ বিষয়ে উচ্ছ¡সিত হওয়ার আশা আপনার কাছ থেকে করা যুক্তিযুক্ত ছিল না। কিন্তু আসল কথা সেটি নয়। বরং আপনার স্বভাবসুলভ বিরুদ্ধস্বভাবের কারণে, আপনি প্রায় সব সময়ে অনিচ্ছায় হলেও শিশুমনে এমন হতাশার জন্ম দিতে এবং এই বিরোধিতার ধারা ক্রমে নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হয়ে দিন দিন ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠেছিল। একপর্যায়ে এমনও হতো যে আপনি যদি একবারের জন্য আমার সঙ্গে একমতও হতেন, তবুও সেই বিরুদ্ধতার ছাঁচটা থেকেই যেত। শেষ পর্যন্ত, শিশুটির এই হতাশাগুলো জীবনের সাধারণ হতাশা ছিল না; কারণ, এতে জড়িয়ে ছিলেন আপনি–একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ফলে সেগুলো আঘাত করত একেবারে হৃদয়ের গভীরে।'
মানুষের অস্তিত্ব অন্য যে অস্তিত্বের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে, তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ মনোভাব নিয়ে কারও সোজা হয়ে দাঁড়ানোই কঠিন। সেই অনুভ'তি ধসিয়ে দেয় ব্যক্তিকে, তার বোধের সবগুলো স্তরকে। যেখান থেকে হয় নতুন কোনো স্বতন্ত্র ভাবনার উন্মেষ ঘটে কিংবা সবকিছু সমেত তলিয়ে যায় অনন্ত এক গড্ডালিকায়। বলা বাহুল্য কাফকার ক্ষেত্রে প্রথমটাই ঘটেছে। নতুন এক চিন্তার বিস্ফোরণ ঘটেছে। এমন চিন্তা যা বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যজগৎকে তো বটেই, বরং ভাবগত জগৎকেও কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এমনকি এই চিন্তার সন্তান হিসেবে আমরা 'কাফকায়েস্ক' নামে একটা বিশেষ প্রপঞ্চও পেয়ে যাই, যা সাধারণত ব্যক্তির অসহায়ত্ব, নিয়ন্ত্রণহীনতা, অস্তিত্ববাদী আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা বা হতাশাকে নির্দেশ করে।
বাবাকে লেখা চিঠিগুলোর পড়ার পর যে কেউ কাফকার এই কাতর দশার জন্য তাঁর বাবার দিকে আঙুল তুলতে পারে। একজন মানুষের ধসে পড়ার এত সাক্ষ্যপ্রমাণ আর কোথাও আছে কি না, বলা মুশকিল। কাফকার প্রতি বাবার অন্যায্যতা চিঠিতে লেখা এই রূপক ঘটনাটিতেও অনেকটা ধরা পড়ে। কাফকা লিখেছেন, 'মূল ব্যাপার ছিল রুটি যেন সোজা কাটা হয়। কিন্তু এতে কিছু যায় আসে না যে আপনি সেটা করছিলেন গ্রেভি-মাখা ছুরি দিয়ে। খেয়াল রাখতে হতো যেন কোনো টুকরো মেঝেতে না পড়ে। অথচ শেষ পর্যন্ত দেখা যেত, সবচেয়ে বেশি টুকরো পড়ে থাকত আপনার চেয়ারের নিচে।'
বাবার সঙ্গে সম্পর্কের যে অসমতা ও অন্যায্যতা, তার মাঝে নো ম্যানস ল্যান্ড বলে কিছু ছিল না। দুজনের জন্য কোথাও দাঁড়ানোর মতো কোনো খালি জায়গাই ছিলই না। ফলে এই সংঘর্ষের একটা করুণ পরিণতি অনিবার্যই ছিল। আর সেই অনিবার্য পরিণতি সারা জীবন নিজেরে শরীর এবং বয়ে বেরিয়েছেন কাফকা। এটা এমন পরিণতি যা আমাদের শঙ্কিত করে। এক বিমর্ষ অচৈতন্যের দিকে ঠেলে দেয় আমাদের অস্তিত্বকেও।

এ ধরনের ঘটনা একটা শিশুমন কী ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত করে, তা ধারণাও করা যায় না। যখন ন্যায়-অন্যায় এবং ভালো-মন্দের একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি হওয়ার কথা, তখন সেখানে ভয়-ঘৃণা-হতাশা এবং বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই উৎপাদিত হচ্ছে না। কাফকার মতো প্রবল প্রতিভাসম্পন্ন না হলে অন্ধকার কোনো টানেলে গিয়েই ঠাঁই হয় সেই সব সরল মনের। এরপর সেই মন আর মোটেই সরল থাকে না। বাস্তবতার ধারণাও হয়ে পড়ে ধূসর এবং মলিন। তবে কাফকা সেই চিরায়ত অন্ধকার টানেল ধরে না ঢুকলেও এক অনিশ্চয়তা ও প্রবঞ্চনার বোধ তার ভেতর তীব্র হতে থাকে। যা তাঁর শরীর ও মনকে ক্রমে গভীর চোরাবালির দিকে টেনে নিতে থাকে। সেই বোধ এতটাই তীব্র যে মৃত্যুর পূর্বে নিজের লেখাপত্র পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ নিজের সৃষ্টিকর্মসহ সব মুছে ফেলতে চাইছেন, ভয়ংকর আত্মবিধ্বংসী না হলে এভাবে কে ভাবতে পারে!
তবে কাফকার এই মানসিক অবস্থার সম্ভাব্য কারণটা আমাদের জানাই হতো না, যদি বাবা তাকে সেই প্রশ্নটা না করতেন। প্রশ্নটা ছিল, 'তুমি আমাকে এত ভয় পাও কেন?' যে প্রশ্নের উত্তরেই মূলত চিঠিসুলভ একটা বই লিখে ফেলেছিলেন কাফকা; যার শুরুটা ছিল এমন–
'প্রিয় পিতা,
কদিন আগে আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কেন আমি বলি যে আমি আপনাকে ভয় পাই। স্বাভাবিকভাবেই, আমি আপনার প্রশ্নের কোনো উত্তর তখন দিতে পারিনি–আংশিক কারণ, আমি সত্যিই আপনাকে ভয় পাই, আর আংশিক কারণ এ-ও যে, এই ভয়ের পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে এমন অনেক বিশদ বিষয়ে যেতে হতো, যা কথার মাধ্যমে বোঝানো অসম্ভব। আর যদি আমি এখন এই চিঠির মাধ্যমে আপনাকে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি, তবুও তা খুবই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে; কারণ, এমনকি লেখার মধ্যেও এই ভয় এবং এর পরিণতিগুলো আমাকে আটকে দিচ্ছে এবং এই বিষয়টির ব্যাপকতা আমার স্মৃতি ও যুক্তিশক্তির সীমাকেও অতিক্রম করে যায়।'
এই ধরনের ভয়ের সঙ্গে আমাদের সবারই কমবেশি পরিচিতি আছে। শৈশবে কোনো একটা গাছ দেখিয়ে যদি আমাদের বলা হতো, এই গাছে ভ'ত আছে, তবে বড় হওয়ার পরও সেই গাছের কাছ দিয়ে যাওয়া সময় শরীর ভারী হয়ে আসে, পা ফেলতেই গা ছমছম করে। এখন কারও ভয়ের কারণ যদি স্বয়ং তার বাবা হন, তবে সে এক বেদনাদায়ক ব্যাপারই হয়। সেই ভয়টা এমন যে দূর থেকে চিঠি লেখার সময়ও তা শরীর ও মনে ভর করে।
কাফকাকে যা সহ্য করতে হয়েছে, সেটা মূলত কর্তৃত্বপরায়ণ ও আত্মমুগ্ধ এক মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অত্যাচার। নিজেকে অন্যের চেয়ে সুপিরিয়র ভাবার এই দ্ব›দ্বই মূলত নিজের সন্তানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। হ্যাঁ, এর ফলে আমরা হয়তো পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম এক লেখককে পেয়েছি, কিন্তু এ পথে কাফকাকে যে অমানুষিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, তা অবর্ণনীয়। বাবার সম্পর্কে কাফকা তাঁর রায় দিচ্ছেন এভাবে, 'যা সব সময় আমার কাছে অবোধ্য ছিল, কথা ও রায় দিয়ে আমার ওপর আপনার যন্ত্রণা ও লজ্জার বোঝা চাপানো এবং সেই কষ্টের প্রতি আপনার সম্পূর্ণ অনুভ'তিহীনতা। যেন আপনার নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। আমিও নিশ্চিতভাবে আপনাকে কষ্ট দিয়েছি অনেকবার, কিন্তু আমি সেটা সব সময় জানতাম, আর বিষয়টা আমাকে কষ্ট দিত, কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না। কথাগুলো আটকে রাখতে পারতাম না, বলার সময়ই কষ্ট পেতাম। কিন্তু আপনি কথা বলতেন নির্দ্বিধায়। কারও জন্য আপনার দুঃখবোধ ছিল না। বলার সময়ও না, পরেও না; আপনার সামনে দাঁড়ানোর কোনো পথই ছিল না।'

এই যে বাবার সামনে দাঁড়াতে না পারার, দাঁড়িয়ে নিজের কথাটুকু বলতে না পারার যে আক্ষেপ, সেটা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় কাফকার জন্মের তিন বছর আগে প্রকাশিত একটা উপন্যাসের কাছে। উপন্যাসটির নাম 'ব্রাদার্স কারামাজভ'; যে উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল বাবা ও তার ছেলেদের জটিল সম্পর্ক। দস্তয়েভস্কি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত কাফকা নিজের বাবার সঙ্গে সম্পর্কে নিয়ে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে দস্তয়েভস্কির কাছ থেকেই ধার করেছিলেন। দস্তয়েভস্কিকে অবশ্য তিনি 'রক্তের ভাই' বলে সম্বোধন করেছিলেন। ফলে ধার নেওয়াটায় একেবারেই অস্বাভাবিক ছিল না। কারামাজভ ভাইদের কিংবা স্বয়ং দস্তয়েভস্কিকে কাফকার এই চিঠিতেও পাওয়া যায় তীব্রভাবে। আর পেয়ে যাওয়ার ঘটনা কাকতালীয় কিছু বলেও মনে হয় না। দুজনের লেখা মিলিয়ে পাঠ করলেও কাফকা ও দস্তয়েভস্কির রক্তের বন্ধনটা টের পাওয়া যায়। দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন, 'আমরা সবাই বেরিয়েছি গোগোলের ওভারকোট থেকে।' আমার ধারণা, কাফকা ব্যতিক্রম, তিনি বেরিয়েছেন খোদ দস্তয়েভস্কির ওভারকোট থেকে। আর যেখানে বাবা সম্পর্কে দুজনের দর্শনগত মিল খানিকটা প্রভাবকের ভ'মিকাই পালন করেছে।
এই লেখাটা শুরু করেছিলাম নিজের মেয়েকে নিয়ে ডায়েরিতে করা জীবনানন্দের একটা মন্তব্য দিয়ে। এমন কথা আমাদের ঠেলে দেয় সীমাহীন এক বিপন্নতার দিকে। এসব বিপন্ন-বিস্ময়ের কোনো ক'লকিনারা পাওয়া যায় না। তবে এটা মানব মনের সেই দুর্বোধ্য কুঠুরি, যার সন্ধান কদাচিৎই মেলে। মানুষের জীবনে কখনো কখনো এমন মুহূর্ত আসে, যখন সে স্বীকৃতির ঊর্ধ্বে বা স্বর্গীয়ভাবে আরোপিত সম্পর্কগুলো নিয়ে এমন কিছুই ভাবতে বাধ্য হয়, এটা তাঁর স্বভাবজাত। তবে এসব ভাবনা ব্যক্তির একান্তই নিজের। এসব ভাবনাকে সামনে আনার দুঃসাহস সে কখনো দেখায় না। কিন্তু এরপরও কেউ থাকেন, যারা সেই কথাগুলো ডায়েরি পর্যন্ত আনতে পারেন, কেউ আবার চিঠিতে এবং কেউ প্রকাশ্যে কোনো লেখার মধ্য দিয়ে।
আমরা বিস্মিত হয়ে পড়তে পড়তে হুট করে নিজেদের খুঁজে পাই। মনে হয়, কোনো একদিন এমন কিছু আমিও ভেবেছিলাম। যদিও এসব গোপন বিষয় নিয়ে কথা বলা নিষেধ। ওই যে দেবত্ব আরোপ করে আগেই এসব সম্পর্ককে 'অপর' করা হয়েছে। শিল্পসাহিত্যেও যুগ যুগ ধরে এসব বিষয়কে পবিত্র জ্ঞান করা হয়েছে। এ ধরনের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলা, এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো গর্হিত কাজই বটে। কিন্তু এই ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দেন দস্তয়েভস্কি, জীবনানন্দ কিংবা কাফকারা এসে। পিতৃহন্তা বা পিতার প্রতি ঘৃণাকে অন্য যেকোনো অপরাধের পাশে রেখে সমরেখায় দেখতে পারেন তারা। এসবে যদিও আমাদের ছাঁচে গড়া মনে অস্বস্তি তৈরি হয়। আমরা সহজে মেনে নিতে পারি না। এড়িয়ে চলে যাই অন্য কোনো অধ্যায়ে। তবু আমাদের মনে বাজতে থাকে কাফকার এই লাইনগুলো–'সূর্যের ঠিক মাঝখানে গিয়েই দাঁড়াতে হবে এমন নয়, তারচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে এমন একটা খোলা জায়গায় গিয়ে পৌঁছানো, যেখানে মাঝেমধ্যে সূর্যের আলো পড়ে। যেখানে দাঁড়িয়ে কিছুটা উষ্ণতাও পাওয়া যায়।'
হ্যাঁ, মিশে না গিয়ে এই পার্থক্যটুকু বজায় রেখেই হয়তো দাঁড়াতে হয়। দূর থেকেই খানিকটা উত্তাপ নিয়ে ফিরে যেতে হয় নিজের জগতে। এটাই মূলত সম্পর্কের প্রকৃত ভারসাম্য, মোটেই আরোপিত কিছু নয়। তবে কাফকার ভেতরের দহন, এইসব চিঠি নাকি তার বাবা হেরমান কাফকার কখনো পড়া হয়নি। তার না পড়ায় অবশ্য আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। আমরা বরং একটা সংবেদনশীল, তীব্র ও বাঁকানো মনের পেছনে লুকিয়ে থাকা কার্যকারণগুলো বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, কীভাবে যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে তৈরি হচ্ছে একটা 'কাফকায়েস্ক' পবিত্র আত্মা। সেটা না হলে যে ভিন্ন কিছু হতে পারত, সে ইঙ্গিতও কাফকা দিয়েছেন। সব শেষে তাই আমরা অস্পষ্ট স্বরে হেরমান কাফকাকে একটা ধন্যবাদও দিতে পারি। তার কর্তৃত্বপরায়ণ হৃদয়েরই যে ফসল ফ্রানৎস কাফফা। ভাগ্যিস তিনি ছিলেন বলে...