এক বছরে শীর্ষ ১০ মার্কিন ধনীর সম্পদ বেড়েছে ৩৬৫ বিলিয়ন, এবার পাচ্ছেন বিশাল করছাড়ও

গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১০ ধনকুবেরের সম্পদ বেড়েছে ৩৬৫ বিলিয়ন ডলার—অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। অক্সফামের নতুন এক বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালে একজন গড় মার্কিন কর্মীর বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ৫০ হাজার ডলারের কিছু বেশি। অক্সফামের হিসাব অনুযায়ী, এমন ১০ জন কর্মীর ওই পরিমাণ আয় করতে সময় লাগবে প্রায় ৭ লাখ ২৬ হাজার বছর।
পরিসংখ্যানটি যুক্তরাষ্ট্রে ধনসম্পদের অসম বণ্টনকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। এমন এক সময় পরিসংখ্যানটি প্রকাশিত হলো, যখন রিপাবলিকান পার্টি একটি বিল পাশের উদ্যোগ নিচ্ছে—যা বিশেষজ্ঞদের মতে ধনীদের আরও ধনী করবে এবং নিরাপত্তা খাতে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার কাটছাঁট করবে।
অক্সফাম আমেরিকার জ্যেষ্ঠ নীতিবিশ্লেষক রেবেকা রিডেল বলেন, 'ধনকুবেরদের সম্পদ আকাশচুম্বী হারে বাড়ছে, অথচ সাধারণ মানুষ নিত্যদিনের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।'
এক বছরে ইলন মাস্কের সম্পদ বেড়েছে ১৮৬ বিলিয়ন ডলার
২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১০ ধনকুবেরের সম্পদ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর মধ্যে শুধু ইলন মাস্কের একার সম্পদই বেড়েছে ১৮৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি—যা পুরো প্রবৃদ্ধির অর্ধেকেরও বেশি।
এর আগে এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ইলন মাস্ক হতে পারেন বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার।
এছাড়া মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ এবং ওয়ালমার্ট উত্তরাধিকারী রব ওয়ালটনের সম্পদ বেড়েছে ৩৮.৭ বিলিয়ন ডলার করে। ওয়ারেন বাফেটের সম্পদ বেড়েছে ৩৪.৮ বিলিয়ন ডলার এবং জিম ওয়ালটনের ৩৬.৫ বিলিয়ন ডলার।
তবে গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিনসহ কয়েকজন ধনকুবেরের সম্পদ কমেছে।
অক্সফাম বলছে, রিপাবলিকানদের প্রস্তাবিত বিল ধনীদের আরও সুবিধা দেবে এবং সাধারণ মানুষের জন্য পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল করে তুলবে।
আসন্ন বিলের বিরোধিতায় প্রগতিশীলরা ধনকুবেরদের সম্পদের ওপর কর আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। অক্সফাম জানায়, ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের ওপর মাত্র ৩ শতাংশ কর বসালেই শুধু এই শীর্ষ ১০ জন ধনীর কাছ থেকেই আদায় করা যাবে ৫০ বিলিয়ন ডলার—যা এক বছরে ২ কোটি ২৫ লাখ মার্কিনীকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তবে সম্পদ কর বাস্তবায়ন এত সহজও নয়। কারণ, একজন ব্যক্তির সম্পদের সঠিক মূল্য নির্ধারণ এবং এ ধরনের কর আদৌ সাংবিধানিক কি না, তা নিয়েও কিছু আইন বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন রয়েছে।
'ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল'–-লাভবান হবে ধনীরাই, বঞ্চিত নিম্ন-আয়ের মানুষ
২০১৭ সালে ট্রাম্পের নেতৃত্বে পাশ হওয়া 'ট্যাক্স কাটস অ্যান্ড জবস অ্যাক্ট'-এর মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা নতুন করে বিতর্কে নেমেছেন। প্রতিনিধি পরিষদে ইতিমধ্যে 'ওয়ান বিগ বিউটিফুল অ্যাক্ট' নামে একটি বিল পাশ হয়েছে, যা ২০১৭ সালের আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত আয়কর সুবিধাকে স্থায়ী করবে এবং টিপস ও ওভারটাইমের ওপর কর সাময়িকভাবে কমাবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল বাজেট অফিস (সিবিও) বলছে, এই বিল গৃহীত হলে গড় হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবারগুলো কিছুটা আর্থিক সুবিধা পাবে ঠিকই, তবে তা সবার মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হবে না। বরং অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও তীব্র হতে পারে।
সিবিওর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০৩৩ সাল নাগাদ সর্বনিম্ন আয় করা ১০ শতাংশ পরিবারের সম্পদ ৪ শতাংশ কমে যাবে, অথচ শীর্ষ ১০ শতাংশ আয়কারীর সম্পদ ২ শতাংশ বাড়বে—মূলত কর হ্রাসের কারণেই।
পেন ওয়ার্টন বাজেট মডেলের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আইনটি বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জিডিপি আগামী ১০ বছরে ০.৫ শতাংশ এবং ৩০ বছরে ১.৭ শতাংশ বাড়বে।
তবে এই আইন অনুযায়ী যে অর্থনৈতিক সুবিধা আসবে, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৫ শতাংশ) পাবে সমাজের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী। অপরদিকে, সমাজের নিচের ২০ শতাংশ পরিবার ২০২৬ সালে মাথাপিছু প্রায় ১ হাজার ৩৫ ডলার হারাবে—মেডিকেইড, ফুড স্ট্যাম্পসহ অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মসূচির বাজেটে কাটছাঁট করার কারণে।
ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন বলেন, রিপাবলিকানদের বিল ধনীদের জন্য একটি 'উপহার'।
তিনি বলেন, 'ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকানরা ধনকুবেরদের জন্য বিশাল করছাড় বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে উঠেছে, যেখানে এই ধনকুবেররা প্রতিদিনই ধনী হচ্ছেন। অথচ করছাড়ের প্রয়োজন ছিল সাধারণ মানুষের।'
তবে হোয়াইট হাউস বলছে, ট্রাম্পের বাজেট পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য আরও কল্যাণ বয়ে আনবে এবং তার প্রথম মেয়াদের অর্থনৈতিক অর্জনকে আরও প্রসারিত করবে।
হোয়াইট হাউস মুখপাত্র কুশ দেশাই বলেন, 'ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে করছাড়, নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণ, অভ্যন্তরীণ জ্বালানি উৎপাদন ও শুল্কনীতি গ্রহণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো সম্পদ বৈষম্য কমেছিল। এই 'ওয়ান বিগ বিউটিফুল অ্যাক্ট' সেই সফল নীতিগুলো স্থায়ী করতে যাচ্ছে এবং 'মেইন স্ট্রিট'-এ আবারও সমৃদ্ধি ফেরাবে।'
এমন এক সময়ে বিতর্কটি উঠেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে।
গত শুক্রবার ক্রেডিট রেটিং সংস্থা 'মুডিজ' ১৯১৭ সাল থেকে ধরে রাখা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্রেডিট রেটিং নামিয়ে দিয়েছে। তাদের মতে, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ঋণের পরিমাণ ও সুদহার বিপজ্জনক হারে বেড়েছে।
যদিও হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রিপাবলিকানদের কর বিল খরচ কমিয়ে এই উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করবে।
গত সোমবার হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলাইন লেভিট বলেন, 'এই বিস্তৃত আইন প্রণয়ন দেশের ঘাটতি বাড়াবে না।'
তবে মুডিজের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, এই প্রস্তাবিত আইন থেকে দীর্ঘমেয়াদে ব্যয় হ্রাস বা ঘাটতি কমানোর কার্যকর কোনো ফল আশা করা যায় না।
অন্যদিকে, 'কমিটি ফর আ রেসপনসিবল ফেডারেল বাজেট' নামের অর্থনৈতিক তদারকি সংস্থাটি সতর্ক করেছে, রিপাবলিকানদের বিলটি দশ বছরে ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ বাড়াবে, সুদসহ এই পরিমাণ বেড়ে ৫.২ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে যদি অস্থায়ী সুবিধাগুলো স্থায়ী করা হয়।
কংগ্রেশনাল বাজেট অফিস (সিবিও) বলেছে, বিলটি একাই জাতীয় ঋণ ৩.৮ ট্রিলিয়ন ডলার বাড়াবে।
কমিটির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই অতিরিক্ত স্বল্পমেয়াদি ঋণ ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ও সুদহার দুটোই বাড়াতে পারে।
- অনুবাদ: আয়েশা হুমায়রা ওয়ারেসা