ইউক্রেন সংকট দীর্ঘায়িত করতে চাইছে কারা?

তুরস্কে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) শেষ দফা আলোচনার পর উভয় পক্ষই সমঝোতা নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার পরিবর্তে ইউক্রেন নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণের প্রস্তাব করেছে। অন্যদিকে রাশিয়া বলেছে দেশটি কিয়েভ, চেরনিহিভ ও আশেপাশের অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা প্রত্যাহার করবে।
তবে আমেরিকা যে এই সমঝোতা চায় না তা স্পষ্ট।
বুধবার হোয়াইট হাউজের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কমিউনিকেশন ডিরেক্টর কেট বেডিংফিল্ডকে জিজ্ঞেস করা হয়, "যুক্তরাষ্ট্র কি ইউক্রেনে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে আগ্রহী বা এমন কিছু ভাবছে?" উত্তরে বেডিংফিল্ড বলেন, "ইউক্রেন যেন সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করার বিভিন্ন উপায় নিয়েই আমরা ইউক্রেনীয়দের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দেওয়া সম্পর্কে এই মুহূর্তে আমি সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছি না।"
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চীনা নেটিজেনরা বেডিংফিল্ডকে উপহাস করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কথার মমার্থ হলো "আমরা তোমাকে না ডুবানো পর্যন্ত কোনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করব না"।
বেডিংফিল্ডয়ের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে শান্তিচুক্তি চায় না। চায়না ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক লি হাইডং মনে করেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সমঝোতা হলে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে পর্যুদস্ত করার সুযোগ হারাবে।
পরিস্থিতির উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজেরাই নিরাপত্তা গ্যারান্টি প্রদান থেকে বিরত থাকছে না। রাশিয়া সামরিক অভিযান কমিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি জানিয়েছে তা পূরণ করবে না বলেও সতর্ক করছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বুধবার (৩০ মার্চ) এক ফোন কলে শান্তি আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে জানান। সেসময় বাইডেন জেলেনস্কিকে ইউক্রেনে আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পাঠানোর আশ্বাস দেন। বাইডেনের সঙ্গে কথোপকথন শেষে জেলেনস্কি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রতিরক্ষার মুখে রাশিয়া কিয়েভের আশেপাশে সামরিক অভিযান কমাতে বাধ্য হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেনের এই সংঘাত স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক জোরদার করছে। ভবিষ্যতে ইউক্রেন ওয়াশিংটনের নির্দেশনা মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও বাড়াবে বলেই ধারণা। জেলেনস্কির ভিডিও বার্তাই তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেনের আলাপচারিতার অনুমান করলে দুই দেশের আলোচনা অনেকটা এরকম: যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে বলেছে, "তোমাকে রাশিয়ার সঙ্গে তৈরি এই অচলাবস্থা টিকিয়ে রাখতে হবে, যাতে আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি"। অন্যদিকে ইউক্রেন বলেছে, "ঠিক আছে, আমি দেখছি"।
লি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের মীমাংসা না চাওয়ার আরেকটি কারণ হলো তারা রাশিয়াকে কোনঠাসা করে ইউরোপকে আরও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে ইচ্ছুক।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, ওয়াশিংটন এই সংকট থেকে সুবিধা আদায়ে সতর্ক । উদাহরণস্বরূপ, জ্বালানি গ্যাস নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তির উদ্দেশ্য ইউরোপের রাশিয়ান জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে আনা। কিন্তু এই চুক্তি রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমালেও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ইউরোপের নির্ভরতা বাড়াবে। ফলে ইউরোপে মার্কিন আধিপত্য আরও জোরদার হবে।
২৪ মার্চ ন্যাটো এক বিবৃতিতে "ইউক্রেনকে রাজনৈতিক ও কার্যকর সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখা" এবং "মিত্ররা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াচ্ছে" বলে উল্লেখ করে। ন্যাটোর ভূমিকা বৃদ্ধির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক সুসংহত করছে। যুদ্ধ ও সংকট বৃদ্ধিতে উস্কানি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে তাদের পক্ষে আনতে বাধ্য করেছে। একইসঙ্গে পুরো পরিস্থিতিতে নিজেদের প্রতিনিধিত্বকারী ভাবমূর্তিও বজায় রেখেছে। ওয়াশিংটনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ইউরোপকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনায় পানি ঢালার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র পুরো সংঘাতের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। নিজেদের কৌশলগত স্বার্থসিদ্ধির কথা মাথায় রেখেই তারা আগাচ্ছে। ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার শর্ত পূরণ হলে বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তার একটি নতুন মডেল স্থাপিত হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর প্রভাব কমবে, যা ওয়াশিংটন স্পষ্টভাবেই তা চায় না।
পুরো বিষয়টি দেখলে সমগ্র ইউরোপের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। আর তাই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধবিরতিতে সবচেয়ে নাখোশ হবে যুক্তরাষ্ট্র।
- সূত্র: গ্লোবাল টাইমস