ট্রাম্পের বাজেট বিল পাস, এখন ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝার কী করবে যুক্তরাষ্ট্র?
গত ৩জুলাই মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে পাস হয় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বহুল আলোচিত 'বিগ বিউটিফুল বাজেট বিল'।
ডেমোক্র্যাটরা শুরু থেকেই বিলটির বিরোধিতা করার পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতরেও ছিল বিলটি নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ। এমনকি ট্রাম্পের একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং টেসলা সিইও ইলন মাস্কও একে উল্লেখ করেন 'জঘন্য ও বিকৃত এক পরিকল্পনা' হিসেবে।
এখন মাত্র অল্প ব্যবধানে বিলটি পাস হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ঋণগ্রহণের পরিমাণ ও স্থায়িত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে থাকা সংশয়গুলো আবারও নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ট্রাম্পের এই কর-ছাড়কেন্দ্রিক বাজেট বিল আগামী কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণে কমপক্ষে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেখানে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জাতীয় ঋণের পরিমাণই প্রায় ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলার।
মার্কিন ঋণপত্রে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল দেশটির অর্থনীতি ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—বিশ্ববাজারে 'আঙ্কল স্যাম' নামে খ্যাত ঋণের ভারে জর্জরিত যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের অন্যান্য দেশ আর কতদিন পর্যন্ত ঋণ দিতে আগ্রহী?
ইতোমধ্যেই ডলারের মূল্যপতন ও ঋণদাতাদের বাড়তি সুদের দাবিতে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদ্বেগের প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সরকারি আয় ও ব্যয়ের ফারাক পূরণে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে।
চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ব্রিটিশ পাউন্ডের বিপরীতে ডলারের মান কমেছে ১০ শতাংশ এবং ইউরোর বিপরীতে কমেছে ১৫ শতাংশ।
যদিও সামগ্রিকভাবে মার্কিন ঋণের সুদহার স্থিতিশীল রয়েছে, তবে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদের ব্যবধান—যা 'ইয়িল্ড কার্ভ' নামে পরিচিত, তা সম্প্রতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই পার্থক্য বৃদ্ধিই ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের তুলনায় সুদের হার কমানোর পথে যুক্তরাষ্ট্র বেশ ধীরগতিতেই এগিয়েছে, যা সাধারণত ডলারকে আরও শক্তিশালী করার কথা। কারণ, এতে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক আমানতে তুলনামূলক বেশি সুদ পেয়ে থাকেন।
তবুও ডলারের মান কমছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থাও কমছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় হেজ ফান্ড প্রতিষ্ঠান ব্রিজওয়াটার অ্যাসোসিয়েটসের প্রতিষ্ঠাতা রে ডালিও মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ পরিস্থিতি এখন একটি মোড়বিন্দুতে পৌঁছেছে।
তার হিসাবে, এই ধারায় চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতেই দেশটিকে প্রতি বছর ঋণ ও সুদের পরিশোধেই ১০ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হতে পারে।
তিনি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আর্থিক অবস্থা এখন একটি সন্ধিক্ষণে। যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ঋণের বোঝা একদিন এমন মাত্রায় পৌঁছাবে, যেখান থেকে বড় ধরনের কোনও অর্থনৈতিক ঝুঁকি নেয়া ছাড়া আর কোনোভাবে উত্তরণ সম্ভব হবে না ।'
এখন এই 'বড় ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকি' দেখতে কিরকম হতে পারে?
প্রথম বিকল্প হলো—হয় সরকারি ব্যয়ে বড় ধরনের কাটছাঁট, নাহয় করের হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি, অথবা এই দুটি একসঙ্গে।
রে ডালিওর পরামর্শ, বাজেট ঘাটতি যদি এখনই ৬ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা যায়, তাহলে ভবিষ্যতের সংকট অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।
ট্রাম্পের নতুন বাজেট বিল কিছু খাতে ব্যয় কমালেও কর ছাড় আরও বেশি দেওয়ায় সামগ্রিকভাবে ঘাটতি কমার বদলে বরং আরও বেড়েছে। অর্থাৎ, রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী পথে হাঁটছে।
দ্বিতীয় বিকল্প—আগের অনেক আর্থিক সংকটের মতো, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিপুল পরিমাণে টাকা ছাপিয়ে সেই অর্থ দিয়ে সরকারি ঋণ কিনে নিতে পারে, যেমনটা ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু এরও খেসারত রয়েছে। অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। বাড়ি, শেয়ার ইত্যাদি সম্পদের মালিকরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হন মজুরি-নির্ভর সাধারণ মানুষরা। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও তীব্র হয়।
তৃতীয় ও সবচেয়ে ভয়াবহ সম্ভাবনা—যুক্তরাষ্ট্রের ঋণখেলাপি হওয়া। অর্থাৎ, 'পরিশোধ করতে পারব না, করবও না'।
কিন্তু পুরো বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাই যে 'যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ও এর ঋণ পরিশোধে আস্থার' ওপর দাঁড়িয়ে, সে ভিত্তি ভেঙে পড়লে তা ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
'সবচেয়ে পরিষ্কার নোংরা শার্ট'
তাহলে আসলেই কি যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের ঋণ সংকটে পড়তে যাচ্ছে?
বর্তমানে, সৌভাগ্যবশত, তা খুব একটা সম্ভাব্য নয়।
তবে এর পেছনের কারণগুলো যে খুব একটা আশাব্যঞ্জক তা-ও নয়। বাস্তবতা হলো—আমরা চাই বা না চাই, বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের বিকল্প এখনও খুবই সীমিত।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক বন্ড বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ এল-ইরিয়ান বিবিসিকে বলেন, 'অনেক দেশই ডলারে নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে। সবাই জানে ডলারের প্রাধান্য খুব বেশি, আর এ কারণেই স্বর্ণ, ইউরো ও পাউন্ডের দাম বাড়ছে। তবে ব্যাপক পরিসরে এই পরিবর্তন আনা খুব কঠিন।'
তার ভাষায়, 'ডলার এখন যেন সবচেয়ে পরিষ্কার নোংরা শার্ট—অন্য কোনো বিকল্প নেই, তাই এটিই পরে থাকতে হচ্ছে।'
তবে সবকিছু সত্ত্বেও, এখন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মহলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চলছে ডলারের ভবিষ্যৎ ও বিশ্বের মূল ভরসার সম্পদ—মার্কিন সরকারি বন্ড নিয়ে।
সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের গভর্নর জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল ঋণ এবং ডলারের অবস্থান নিয়ে ইউএস ট্রেজারি সচিব বেসেন্ট যথেষ্ট সচেতন।
গভর্নরের ভাষায়, 'আমি মনে করি না ডলার এখনই মৌলিকভাবে কোনও হুমকির মুখে, কিন্তু সচিব এ বিষয়গুলোকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন এবং এসব নিয়ে তিনি অবহেলা করছেন না।'
৩৭ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ—সংখ্যাটি এতটাই বিশাল যে তা কল্পনা করাও কঠিন। প্রতিদিন এক মিলিয়ন ডলার সঞ্চয় করলেও এই পরিমাণ টাকা জমাতে সময় লাগবে প্রায় এক লাখ বছর!
ঋণকে বোঝার সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত উপায় হলো—তা দেশের আয়ের অনুপাতে দেখা। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বছরে প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার আয় করে।
এই হিসাবে দেশটির ঋণ-আয় অনুপাত অনেক দেশের চেয়ে বেশি হলেও, জাপান বা ইতালির মতো নয়। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী ও সম্পদ সৃষ্টিকারী অর্থনীতি, যা এখনও ডলারকে শক্ত অবস্থানে রাখছে।
উইলিয়াম এফ. রিকেনব্যাকার এর লেখা একটি বই আছে, 'ডেথ অব দ্য ডলার'। ১৯৬৮ সালে লেখা সেই বইতে তিনি বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থান হারানোর ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করেছিলেন।
যদিও লেখক এখন আর বেঁচে নেই, কিন্তু ডলার আছে এবং বেশ শক্ত অবস্থানেই।
