মারিউপোল: যে ৪ কারণে রাশিয়ার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ এই শহর!

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহরে পরিণত হয়েছে মারিউপোল। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত তুমুল বোমা হামলার শিকার হয়ে আসছে শহরটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শহরই ইউক্রেনে মস্কোর সামরিক অভিযানে বিজয় ছিনিয়ে আনার চাবিকাঠি। কিন্তু কেন?
ইউক্রেনের এই বন্দরনগরীর দখল নিতে পারা কেন রাশিয়ার জন্য কৌশলগত জয় এবং ইউক্রেনের জন্য একটি বড় ধাক্কা, তার চারটি প্রধান কারণ ব্যাখ্যা করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
ক্রিমিয়া ও দনবাসের মধ্যে একটি 'ল্যান্ড করিডোর' (স্থল পথ) তৈরি
ভৌগোলিকভাবে, মারিউপোল শহরটি মানচিত্রে ছোট্ট একটি এলাকা দখল করে থাকলেও, এটি এখন ক্রিমিয়ান উপদ্বীপ হয়ে আসা রুশ বাহিনীর পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে তাদের কমরেড ও ইউক্রেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী মিত্রদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে নজর দিচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট ফোর্সেস কমান্ডের সাবেক কমান্ডার জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারনসের মতে, মারিউপোল দখল করা রাশিয়ার যুদ্ধ কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তিনি বলেন, 'রুশদের যখন মনে হবে তারা যুদ্ধ সফলভাবে শেষ করেছে, তখন তারা রাশিয়া থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত একটি স্থলসংযোগ পথ নির্মাণ করবে; একে বড় ধরনের কৌশলগত সাফল্য হিসেবে দেখছে তারা।'
মারিউপোল দখল করতে পারলে রাশিয়া ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগর উপকূলের ৮০ শতাংশেরও বেশি এলাকার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারবে। এর মাধ্যমে ইউক্রেনের সামুদ্রিক বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে পুরো বিশ্ব থেকে দেশটিকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হবে রাশিয়া।
রুশ সেনারা কামান, রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে মারিউপোল শহরের ৯০ শতাংশেরও বেশি ধ্বংস করেছে ইতোমধ্যেই। সোমবার ভোর ৫টার মধ্যে শহরের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আত্মসমার্পণের সময়সীমা বেধে দিয়েছিল রাশিয়া। কিন্তু মারিউপোল তা প্রত্যাখ্যান করায় রুশ বাহিনী শহরের বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, মারিউপোল এখন মানবসৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
ইউক্রেনের অর্থনীতির ওপর হামলা
দীর্ঘদিন ধরেই কৃষ্ণ সাগরের অংশ আজভ সাগরের একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর মারিউপোল।
এটি আজভ সাগর অঞ্চলের বৃহত্তম বন্দর। লোহা ও ইস্পাত শিল্পের জন্য এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক। স্বাভাবিক সময়ে, মারিউপোল ইউক্রেনের ইস্পাত, কয়লা ও ভুট্টা রপ্তানির প্রধান কেন্দ্র। এখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে এসব পণ্য রপ্তানি করা হয়।
তবে ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর, এই শহরটি গত আট বছর ধরে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে অবস্থানরত রুশ বাহিনী এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের ক্রেমলিনপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে অনেকটা স্যান্ডউইচে পরিণত হয়েছে।
মারিউপোলকে হারানো ইউক্রেনের অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় ধাক্কা হবে।
প্রোপাগান্ডার সুযোগ
আজভ ব্রিগেড নামে ইউক্রেনের একটি মিলিশিয়া ইউনিটের আবাসস্থল হলো মারিউপোল শহর। চরম-ডানপন্থী এই মিলিশিয়া বাহিনী 'নব্য-নাৎসিবাদী' হিসেবেও পরিচিত।
বর্তমানে তারা ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে এক হয়ে রুশদের বিরুদ্ধে লড়ছে। তাই পশ্চিমাদের ধারণা, আজভ বাহিনীর 'নাৎসি নেতিবাচকতাকে' রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
মনোবল বৃদ্ধি
যদি সত্যিই রাশিয়া মারিউপোল দখল করে নেয়, তাহলে এটি লড়াইরত দুই বাহিনীর ওপরেই গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলবে।
রাশিয়ার মারিউপোল বিজয় রুশ বাহিনীর মনোবল বাড়াবে। অন্যদিকে, ঠিক বিপরীত ঘটনাটি ঘটবে ইউক্রেনীয় সেনাদের ক্ষেত্রে। তাদের মনোবল ভেঙে যাবে। শহরটি রাশিয়ার টার্গেটে পরিণত হওয়ার এটিও একটি অন্যতম কারণ।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে এই যুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। তিনি ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগরের উপকূলরেখাকে 'নভোরোসিয়া' (নতুন রাশিয়া) নামের জায়গা হিসেবে দেখতে চান, যা আঠারো শতকে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। এমনটিই দাবি করা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে।
সেখানে আরও দাবি করা হয়েছে, 'কিয়েভের পশ্চিমপন্থী সরকারের অত্যাচার থেকে রুশদের উদ্ধার করছে রাশিয়া', এমন ধারণাকেই পুনরুজ্জীবিত করতে চান পুতিন। আর মারিউপোল বর্তমানে তার সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই শহরটিকে রুশ দখলে নেওয়া পুতিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, ইউক্রেনীয়দের জন্য মারিউপোল হারানো হবে বড় ধাক্কা; কেবল সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবেই নয়, বরং ইউক্রেনকে রক্ষা করতে যেসব সাধারণ মানুষ লড়াই করে চলছে, তাদের মনবলেও এই ঘটনা আঘাত হানবে।
খেরসনের পর মারিউপোলই প্রথম কোনো বড় শহর, যেটি রুশদের দখলে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
- সূত্র: বিবিসি