রাশিয়ান গ্যাস থেকে মুক্তি চায় ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা হয়তো ভিন্ন
রাশিয়ার নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইনটি কিনে নেওয়ার জন্য গত মে মাসে, মার্কিন একজন বিনিয়োগকারী জার্মান অর্থনৈতিক কর্মকর্তাদের কাছে দুঃসাহসী এক প্রস্তাব দেন। বিগত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সমুদ্রতল দিয়ে বেছানো এই পাইপলাইনটি ফের চালু করে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনাই ছিল তার।
স্টিফেন পি. লিঞ্চ নামের ওই বিনিয়োগকারী এই প্রস্তাব তার আগেই ট্রাম্প প্রশাসনের কাছেও তুলে ধরেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, জ্বালানির এই কৌশলগত অবকাঠামো নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগ্রহীই হবে যুক্তরাষ্ট্র। সেজন্যই এমন প্রস্তাব দেওয়া ঝুঁকি তিনি নেন। এখন জার্মান কর্মকর্তারাও জানতে চেয়েছেন, কীভাবে লিঞ্চ এই বিতর্কিত পাইপলাইনটি অধিগ্রহণের মাধ্যমে আবার সচল করতে চান— যেটি ২০২২ সালে এক নাশকতামূলক হামলায় আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গত ৬ মে বার্লিনে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকে জার্মান পক্ষ ছিল সন্দিহান। কর্মকর্তারা জানতে চান, রাশিয়ার গ্যাস প্রবাহ আবার শুরু করার অনুমতি কীভাবে পাওয়া যাবে? জবাবে লিঞ্চ বলেন, এটা তার কাজ না। তিনি আশা করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জার্মানির নীতিনির্ধারকেরা নিজেরাই সস্তায় রাশিয়ান গ্যাস কেনার সুবিধাটা উপলদ্ধি করবেন।
ইউরোপের দোরগোড়ায় এখন ইউক্রেন যুদ্ধের আগুন। ভূরাজনৈতিক এক দাবার কৌশলেও যুজতে হচ্ছে ইউরোপের নেতাদের। এরমধ্যেই মহাদেশটি জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউরোপীয় নেতারা চাচ্ছেন, রাশিয়ার গ্যাস আমদানির সব পথ বন্ধ করতে। আজ বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস আবারও জানাবেন যে, তিনি নর্ড স্ট্রিম ২ চালুর বিপক্ষে—এ তথ্য জানিয়েছে তার দপ্তর।
রুশ আগ্রাসনের আগে ইউরোপের দেশগুলো সস্তায় রাশিয়ান গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভর করত, যা ক্রেমলিনকে দিয়েছিল কৌশলগত সুবিধা। সেই ভুল আর করতে চায় না তারা।

রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দেন— "মস্কো যদি (ইউক্রেন) আক্রমণ করে, তাহলে নর্ড স্ট্রিম-২ আর থাকবে না।" এরপর তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাইপলাইন কোম্পানিটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। জার্মানিও নতুন নির্মিত এই পাইপলাইন চালু করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউরোপের সরকার ও ব্যবসাগুলো রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরতা দ্রুত কমিয়ে আনে, মস্কোকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলতেই—যদিও এতে তাদের নিজেদেরও উৎপাদন ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায়।
কিন্তু, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ প্রান্তে পৌঁছালে অথবা ওয়াশিংটনের সঙ্গে মস্কোর ঘনিষ্ঠতা বাড়লে—কম দামে রাশিয়ান গ্যাস কেনার প্রলোভন আবার মাথাচাড়া দিতে পারে, এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না ইউরোপীয় কর্মকর্তারা।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস গত সপ্তাহে স্পষ্ট জানান, নর্ড স্ট্রিম-২ চালু হতে দেবে না তার দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নও সম্প্রতি জানিয়েছে, তারা এমন নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবছে, যাতে বিনিয়োগকারীরা এই পাইপলাইনের কোনো ব্যবসায়িক তৎপরতায় না জড়ায়।
এরমধ্যে নর্ড স্ট্রিম-২ নিয়ে মার্কিন আগ্রহই নতুন করে আলোচনার খোরাক যোগাচ্ছে।
"ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে আলাদা শান্তিচুক্তির চেষ্টা করছেন"—বলছেন কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের বিশ্লেষক সের্গেই ভাকুলেঙ্কো। ইউরোপ এজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যাতে তারা এই চুক্তির অংশ না হয়।
লিঞ্চ যে বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন, সেই বৈঠক নিয়ে জার্মান অর্থ মন্ত্রণালয় মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে জার্মান সংবাদমাধ্যম 'ডি সাইট' নিশ্চিত করেছে যে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকটি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী চাইছে—তারা একসঙ্গে ইউরোপে জীবাশ্ম জ্বালানি বিক্রি করবে। এই প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রের লিঞ্চের মতো বিনিয়োগকারীরা নতুন করে উৎসাহ পাচ্ছেন।
লিঞ্চের মতে, ইউরোপকে একসময় রাশিয়ার গ্যাসের দিকে ফিরতেই হবে। তিনি যুক্তি দেন—একটি মার্কিন কোম্পানি যদি নর্ড স্ট্রিম-২ এর মালিক হয়, তবে পশ্চিমা নজরদারি থাকবে এবং রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি লেনদেন করতে হবে না।
"যখন ওরা (ইউরোপীয় নেতারা) বুঝবেন রাশিয়ান গ্যাস দরকার—ততক্ষণে আমরাও প্রস্তুত থাকব," বলেন লিঞ্চ।
দীর্ঘদিন মস্কোতে বসবাস করেছেন লিঞ্চ। বর্তমানে তিনি থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে। নিজেকে তিনি রাশিয়ান সম্পদের "ডি-রাশিফিকেশন" বিশেষজ্ঞ বলেও দাবি করেন। ২০২২ সালে তিনি মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ থেকে অনুমতি পেয়েছিলেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা রাশিয়ার সেবারব্যাঙ্কের সুইস শাখা কেনার জন্য।
তিনি একসময় খোদ পুতিনের বিরোধী মিখাইল খোদরকোভস্কির কোম্পানির অবশিষ্টাংশ কিনে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এমনকী ২০২৩ সালে বাইডেন প্রশাসনের কাছে নর্ড স্ট্রিম-২ নিয়ে লেনদেনের জন্য লাইসেন্স চেয়ে ব্যর্থ হন।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফেরার পর তিনি আবার আবেদন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, গত এক বছরে তিনি ট্রাম্পের প্রচারণায় ৭ লাখ ডলারের বেশি দান করেছেন।
শান্তি না আসা পর্যন্ত গ্যাস রপ্তানি সম্ভব না
১১ বিলিয়ন ডলারের পাইপলাইনটি বর্তমানে সুইস আদালতে ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় আছে। লিঞ্চ বলেন, অনুমতি পেলে তিনি অন্য বিনিয়োগকারীদের যুক্ত করবেন এবং পাইপলাইনটি অর্ধেক দামে কিনে নেবেন। তবে রাশিয়ার জন্য নির্ধারিত অর্থ একটি ট্রাস্ট ফান্ডে রাখা হবে—যতদিন না যুদ্ধ শেষ হয়।
ওয়াশিংটনে, সেনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের নেতৃত্বে রিপাবলিকানরা এখনো রাশিয়ার জ্বালানি খাতে নতুন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ করছেন। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু অংশ রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি বাণিজ্যে আগ্রহী।
এপ্রিল মাসে আমেরিকান কর্মকর্তারা যখন সম্ভাব্য শান্তি পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করেন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া জ্বালানি সহযোগিতার সম্ভাবনাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানুয়ারিতে বলেছিলেন, "যদি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানিখাতে একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে।"
রাশিয়ার ওয়েলথ ফান্ডের প্রধান কিরিল দিমিত্রিয়েভ হোয়াইট হাউসের দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে।
২০২২ সালের বিস্ফোরণে নর্ড স্ট্রিম-১ ও ২-এর অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা পুনরায় চালু করতে হলে জার্মানির নিরাপত্তা গ্যারান্টির প্রয়োজন হবে।
আমেরিকান মালিকানাধীন হলেও নতুন নিষেধাজ্ঞা গ্যাস আমদানিতে বাধা দেবে কিনা— ইউরোপীয় কমিশন অবশ্য সেবিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিধান্বিত অবস্থান ইউরোপকে বিভ্রান্ত করছে। কারণ, এটি মার্কিন তরল গ্যাস রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
তবে, মার্কিন গ্যাস কোম্পানি ইকিউটির শীর্ষ কর্মকর্তা উইল জর্ডান বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়েছে, জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, "যখন কোনো দেশ জ্বালানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে—তখন তার পরিণাম হয় ভয়াবহ।"