বিশ্ব নতুন এক পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার দ্বারপ্রান্তে: সিপ্রি

মানবতার আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও, বিশ্ব ক্রমশ আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা দিন দিন বাড়ছে। সোমবার (১৬ জুন) প্রকাশিত স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি)-এর বাৎসরিক প্রতিবেদনের উপসংহারে এ মন্তব্য করা হয়।
প্রতিবেদনটিতে সংঘাত, অস্ত্র বাণিজ্য ও সামরিক ব্যয়ের সাম্প্রতিক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এক নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে। সিপ্রির মতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমশ এই প্রতিযোগিতা দানা বাঁধছে।
সিপ্রি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া পুরোনো ১ হাজার পারমাণবিক ওয়ারহেড ধ্বংস করায় মোট ওয়ারহেডের সংখ্যা কমলেও নতুন ওয়ারহেড তাদের ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে এবং কোনো ধরনের চুক্তি না থাকলে এই প্রবণতাই ভবিষ্যতে সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্রের শক্তি, নির্ভুলতা ও সরবরাহ ব্যবস্থা চলমান বিশ্বের সামনে এক নতুন পারমাণবিক যুগের সূচনা করছে।
সিপ্রির পরিচালক ড্যান স্মিথ আল জাজিরাকে বলেন, 'আমরা এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছি, যার সূচনা হয়েছিল কোভিড মহামারির আগেই। এটি খণ্ড খণ্ড কিছু উন্নয়নের বিষয় নয়। এটি একটি সামগ্রিক প্রবণতা, যেখানে উত্তর কোরিয়া থেকে শুরু করে নতুন পারমানবিক শক্তিধর ভারত-পাকিস্তান পর্যন্ত সবাই পারমাণবিক সক্ষমতা উন্নয়নের দিকে এগিয়ে চলেছে।'
পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো যেভাবে তাদের অস্ত্র উন্নত করছে
চীন তার উত্তরাঞ্চলের মরুভূমি ও পার্বত্য এলাকায় ৩৫০টি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ সাইলো নির্মাণ করছে। গত বছরে ১০০টি নতুন পারমাণবিক ওয়ারহেড যুক্ত হয়ে, চীনের মোট ওয়ারহেডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০০টিতে। এই প্রবণতা একইভাবে অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও চীনের 'প্রথমে আঘাত না করার' (নো ফার্স্ট ইউজ) নীতি রয়েছে, তবে তারা 'লঞ্চ অন ওয়ার্নিং' সক্ষমতা (প্রতিক্রিয়াশীল পাল্টা আঘাত) গড়ে তোলার চেষ্টা করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীন ও ভারত—দু'দেশই শান্তিকালেও ক্ষেপণাস্ত্রে ওয়ারহেড স্থাপন করার পথে হাঁটছে,যা তাদের দীর্ঘদিনের ওয়ারহেড এবং ক্ষেপণাস্ত্র আলাদা রাখার নীতিতে পরিবর্তন এনেছে।
ভারত সম্ভবত দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নে মনোযোগ দিচ্ছে। কেননা এখন তারা শুধু পাকিস্তান নয়, চীনকেও বিবেচনায় নিচ্ছে। উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যে ৫০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে এবং আরও ৪০টি তৈরির মতো পরিশোধিত পারমাণবিক পদার্থ মজুদ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা স্বল্প পাল্লার কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র উৎক্ষেপণের ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তানও পারমাণবিক পদার্থ মজুদ করছে এবং সিপ্রির মতে, দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার আগামী এক দশকে আরও সম্প্রসারিত হবে।
যুক্তরাজ্য তাদের ওয়ারহেড সংখ্যা ২২৫ থেকে ২৬০-এ উন্নীত করছে এবং পারমাণবিক-সক্ষমতা সম্পন্ন ড্রেডনট শ্রেণির সাবমেরিন তৈরি করছে। ফ্রান্সও তৃতীয় প্রজন্মের সাবমেরিন এবং আকাশ থেকে নিক্ষেপযোগ্য পারমাণবিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ করছে। ইসরায়েলের বিদ্যমান সাবমেরিনগুলো টর্পেডো টিউব থেকে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তবে তাদের নতুন ড্রাকন সাবমেরিনে উল্লম্ব উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা (ভার্টিকাল লঞ্চ সিস্টেম) থাকতে পারে।
তবে এই সব রাষ্ট্রের যৌথ অস্ত্রভাণ্ডার বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের মাত্র ১০ শতাংশ। বাকি ৯০ শতাংশ অস্ত্র রয়েছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। দেশ দুটির প্রত্যেকের হাতে ১ হাজার ৭০০-এর বেশি সক্রিয় ওয়ারহেড এবং মজুদে রয়েছে আরও ৪ হাজার ৫২১টি।
যুক্তরাষ্ট্র তার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র, সাবমেরিন ও বোমারু বিমানের উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছর তারা ২০০টি 'আধুনিকায়নকৃত' পারমাণবিক ওয়ারহেড মজুদ করেছে। এটি স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর কোনো একক বছরে সর্বোচ্চ। রাশিয়াও তাদের আকাশ ও সমুদ্রভিত্তিক সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করছে এবং তারা বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করে থাকতে পারে। গত বছর দেশটি তার পারমাণবিক নীতি সম্প্রসারিত করেছে।
পূর্বে কেবল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সংকটে পড়লেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দিত রাশিয়া। কিন্তু নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, যদি রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব বা ভূখণ্ডের অখণ্ডতার ওপর 'গুরুতর হুমকি' দেখা দেয়, অথবা যদি 'আকাশ ও মহাকাশ থেকে বড় ধরনের আক্রমণ' হয়, তাহলেও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন মিলবে। এসব আক্রমণের মধ্যে ড্রোনও অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো ইউক্রেন প্রায়ই একযোগে ডজন ডজন পাঠাচ্ছে রাশিয়ার ভেতরে।
সিপ্রি জানিয়েছে, রাশিয়ার এই নতুন নীতি এই অর্থও বোঝাতে পারে যে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের 'সীমা' কমিয়ে ফেলেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়ার প্রচলিত অস্ত্রের মিশ্র ফলাফলই দেশটিকে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর আরও নির্ভরশীল করে তুলতে পারে।
অধিক অস্থিতিশীল বিশ্বে আরও বড় বোমা
এই পরিবর্তনগুলো ঘটছে এমন এক বিশ্বপরিপ্রেক্ষিতে, যেখানে প্রচলিত সশস্ত্র সংঘাত আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। সিপ্রির হিসাবে, ২০২৩ সালে যে সংঘাতে ১ লাখ ৮৮ হাজার জন নিহত হয়েছিলেন, ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজারে। এই হিসাব পাঁচটি বড় সংঘাতকে ঘিরে: ইসরায়েলের গাজা আগ্রাসন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মিয়ানমার ও সুদানের গৃহযুদ্ধ এবং ইথিওপিয়ার 'উপজাতীয় সশস্ত্র সংঘর্ষ'।
সিপ্রির তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় বেড়েছে ৩৭ শতাংশ এবং শুধু গত বছরই বেড়েছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, যা মোট ব্যয়কে নিয়ে গেছে ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
পারমাণবিক অস্ত্রের পাল্লা, ধ্বংসক্ষমতা, নির্ভুলতা ও টিকে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রচলিত সংঘাতের তীব্রতা—এই দুইয়ের সমন্বয়ে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের প্রবণতা আরও বাড়ছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি অ্যানালাইসিসের (সিইপিএ) ট্রান্সআটলান্টিক ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি প্রোগ্রামের ফেলো মিননা আল্যান্ডার।
তিনি বলেন, 'এই পরিস্থিতি ইউরোপের এমন এলাকাতেও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে, যেখানে তা একসময় অকল্পনীয় ছিল। 'নর্ডিক বোমা' বিষয়টি এখন সুইডেন ও ডেনমার্কের রেডিও টকশোর আলোচ্য।' ডেনমার্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়েপে কোফোড সম্প্রতি বলেছেন, 'একটি নর্ডিক প্রতিরক্ষা জোট ও নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র এখন 'শুধু স্বপ্ন নয়, বরং কৌশলগত প্রয়োজন'।'
তিনি বলেন, 'এটি এক উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন। কারণ ডেনমার্ক ও নরওয়ে এর আগে ন্যাটোর পারমাণবিক অস্ত্র রাখার ওপর সীমাবদ্ধতা রেখেছিল, এবং ফিনল্যান্ড ও সুইডেন বরাবরই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ প্রচারণার পক্ষে ছিল।'
এখন ফিনল্যান্ড ও সুইডেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা গত বছর কার্যকর হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশে সেনা ও অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্রও মোতায়েন করতে পারবে। পোল্যান্ডও ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র ভাগাভাগির ব্যাপারে আগ্রহী।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টির ওপর আস্থা এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মত দেন সিপ্রির ড্যান স্মিথ। তার মতে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটোর পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তিকে নির্দিষ্ট সামরিক ব্যয় পূরণের শর্তসাপেক্ষ করে তুলেছেন।
মিননা আল্যান্ডার বলেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের স্বতন্ত্র পারমাণবিক শক্তি মূলত এই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নিয়েছিল—'যুক্তরাষ্ট্র কি নিউ ইয়র্ক কিংবা ওহাইওর একরন শহরকে বলির পাঁঠা বানিয়ে বার্লিনকে রক্ষা করবে?' এখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানই প্রমাণ করে, কেন ফ্রান্স তাদের স্বায়ত্তশাসিত কৌশলকে গুরুত্ব দিয়েছিল।
সিপ্রির তথ্য অনুযায়ী, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৭৮টি দেশ 'কমপ্রিহেনসিভ নিউক্লিয়ার টেস্ট ব্যান ট্রিটি' (সিটিবিটি) অনুসমর্থন করেছে। গত বছর চারটি দেশ 'ট্রিটি অন দ্য প্রহিবিশন অব নিউক্লিয়ার উইপনস' (টিপিএনডব্লিউ) অনুসমর্থন করেছে, যার লক্ষ্য হলো পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা। এ নিয়ে মোট অনুসমর্থনকারী দেশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৩-এ। আরও ২৫টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, তবে অনুসমর্থন করেনি।
সিপ্রির ড্যান স্মিথ বলেন, 'এই নিরস্ত্রীকরণ প্রচেষ্টা এসেছে এই যুক্তি থেকে—পারমাণবিক যুদ্ধে কেউই বিজয়ী হতে পারে না। পারমাণবিক যুগের ৮০ বছর পরও।'
স্মিথ বলেন, 'কোনো পরিস্থিতিতেই পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করার কোনো অর্থ হয় না। আমি প্রায় নিশ্চিত, ইসরায়েল যদি সত্যিকারের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে, তাহলে তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। কিন্তু তাতে কিছুই অর্জিত হবে না। তারা বড়জোর প্রতিশোধ নিতে পারবে।'