এনবিআরের নীতির হঠাৎ পরিবর্তনের কবলে শিপিং খাত, ৩৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হঠাৎ করেই মেরিটাইম খাতের ওপর কর অব্যাহতি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন খাতে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। এতে করে স্থানীয়ভাবে করা ৩৫০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় পড়েছে, এছাড়াও ফ্রেইট থেকে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথও ঝুঁকিতে পড়েছে—যা আগে বিদেশি জাহাজ কোম্পানির কাছে যাওয়া থেকে সাশ্রয় হতো।
কোনো ধরনের পূর্ব আলোচনা ছাড়াই সমুদ্রগামী জাহাজের ওপর ভ্যাট ও কর অব্যাহতি বাতিলের এনবিআরের আকস্মিক সিদ্ধান্তে জাহাজ মালিকরা সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন, আর পুরো শিল্পটি এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
অথচ গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের নীতিগত অবস্থান ছিল স্পষ্ট: বিদেশি জাহাজের ওপর নির্ভরতা কমাতে ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে একটি শক্তিশালী দেশীয় শিপিং বহর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেওয়া।
এ উদ্দেশ্যেই ২০১৯ সালের জুনে এনবিআর জাহাজ কেনার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করে। পরে ২০২৩ সালে আরও এক ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজগুলোর মালামাল (ফ্রেইট) পরিবহনের আয়ে কর অব্যাহতি ঘোষণা করা হয় ২০৩০ সালের জুন পর্যন্ত।
কিন্তু এ নিশ্চয়তার অবসান হয় ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর, যখন এনবিআর জাহাজ আমদানির ওপর ফের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে। এর মাত্র দু'দিন পরই এনবিআর সমুদ্রগামী জাহাজের ভাড়ার আয়ে দেওয়া সকল কর সুবিধা বাতিল করে দেয়। ফলে ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে ৩৯টি জাহাজ থেকে বেড়ে বর্তমানে ১০১টি জাহাজে পৌঁছানো এই নবীন খাতটি কার্যত চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়।
"এ খাত থেকে করছাড় প্রত্যাহার করে এনবিআর নিজস্ব নীতিমালারই লঙ্ঘন করেছে," বলেন বাংলাদেশ ওশেনগোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আজাম জে চৌধুরী। তিনি ২০২৩ সালের একটি এনবিআর আদেশের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে বলা হয়েছিল—বোর্ড বিদ্যমান নির্দেশনা সংশোধন করতে পারবে, কিন্তু নতুন করে কর আরোপ বা করের হার বাড়াতে পারবে না।
আজম জে চৌধুরী উল্লেখ করেন, সরকার ২০৩০ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেওয়ার যে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বিবেচনায় নিয়েই জাহাজ মালিকরা কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করেছিলেন। "এভাবে হঠাৎ, একতরফাভাবে কোনো আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমাদের চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে," বলেন তিনি।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "এই বিনিয়োগগুলো হয়েছিল একটি সুস্পষ্ট নীতির ভিত্তিতে। এখন ঋণ পরিশোধ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, ফলে ঝুঁকির মুখে পড়েছে এমন একটি খাত, যা তৈরি পোশাকের পর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী খাত হিসেবে গড়ে উঠতে পারত।"
ঝুঁকির মুখে বিকাশমান খাত
এই খাতে অগ্রগতি কেবল প্রতীকী ছিল না। সংশ্লিষ্ট শিল্পের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজগুলো প্রায় ১০০ কোটি ডলার ভাড়া আয় করেছে এবং এ শিল্পে নিয়োজিত হয়েছেন ২,০০০ এর বেশি দক্ষ পেশাজীবী, যারা অতিরিক্ত ৭০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এনেছেন।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সমুদ্রগামী জাহাজ পরিবহন খাতটি তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও এখন এ খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২০ শতাংশ এবং তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য ২৭.৫ শতাংশ করহার প্রযোজ্য হচ্ছে। অথচ দীর্ঘদিনের তৈরি পোশাক খাতের করহার মাত্র ১২ শতাংশ, আর সবুজ কারখানাগুলোর জন্য সেটি আরও কমে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। টেক্সটাইলসহ অন্যান্য খাতগুলোও কর রেয়াত সুবিধা পাচ্ছে, আর তথ্যপ্রযুক্তি খাত পুরোপুরি করমুক্ত সুবিধা ভোগ করছে।
এছাড়া, অগ্রিম আয়কর ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও এটি সমন্বয়যোগ্য, তবে একটি জাহাজ কিনতে সাধারণত ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়, ফলে এ অগ্রিম কর বাবদ একটি বড় অঙ্কের টাকা আগেভাগেই দিতে হচ্ছে।
এর পাশাপাশি, সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন থেকে আয় হলে দেশের বাইরে পরিবহনের জন্য ৫ শতাংশ এবং দেশের ভেতরে পরিবহনের জন্য ৩ শতাংশ আয়কর প্রযোজ্য হচ্ছে, সঙ্গে রয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট। সব মিলিয়ে এ খাতে কার্যকর করের হার দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩০ শতাংশে।
আগের করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়ার ফলে সমুদ্রগামী জাহাজ পরিবহন খাতে মোট করের প্রভাব ৩০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এতে খাতটির অগ্রগতি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে এবং নতুন বিনিয়োগ কমে যেতে পারে।
"এই পরিস্থিতিতে আমাদের জাহাজ বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকবে না। এই করনীতির আওতায় থেকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অসম্ভব," বলেন মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফা কামাল। এমজিআই বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রগামী জাহাজ বহরের মালিক, যার সংখ্যা ২৫টি।
গত পাঁচ বছরে ৬০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করা কামাল জানান, "আমাদের প্রতিবেশী কোনো দেশেই এমন করব্যবস্থা নেই। আমি নতুন জাহাজ কেনার পরিকল্পনা আপাতত বন্ধ রেখেছি, যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে এখন দামের দিক দিয়ে তা লাভজনক।"
শিল্প সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, যাদের জাহাজ এখনো নির্মাণাধীন বা অর্ডারে রয়েছে, সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসবে তাদের ওপর। যেমন এমজেএল বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগে তিনটি জাহাজ—দুটি ট্যাংকার ও একটি গ্যাস ক্যারিয়ার—কেনার চুক্তি করেছে, যেগুলো ২০২৬ সালের মধ্যে সরবরাহের কথা রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমজেএলের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, "নীতিগত এই পরিবর্তনের ফলে এমজেএলের বছরে মোট আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ১৯ মিলিয়ন ডলার—যা এই জাহাজগুলো থেকে প্রত্যাশিত আয়ের চেয়েও বেশি।"
দেশের অন্যতম বৃহৎ ও পুরোনো জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং-এর প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিম জানিয়েছেন, খাতটির জন্য হঠাৎ করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়ায় কোম্পানিটি নতুন জাহাজ কেনার পরিকল্পনা স্থগিত করেছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ওশেনগোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী সরকারের এই অবস্থানের সমালোচনা করে 'বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন'-এর সংস্কারে অব্যাহত অনীহার বিষয়টিও তুলে ধরেন। এই আইন অনুযায়ী, সরকারি অর্থায়নের সব কার্গো পরিবহন শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত জাহাজে করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) দেশের সমুদ্রগামী বহরের মাত্র ১০ শতাংশেরও কমের মালিক; বাকি সম্পূর্ণ অংশটি নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি শিপিং অপারেটররা।
"এই আইন বেসরকারি খাতের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে না। একটি দেশের মধ্যে দুটি পতাকার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এটি সমতা, ন্যায়বিচার এবং এমনকি সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক," বলেন আজম জে চৌধুরী।
কেন হঠাৎ করে এ খাতের করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হলো—এ প্রশ্নের জবাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশের ভিত্তিতে নেওয়া সিদ্ধান্ত। আইএমএফ এনবিআরকে বিভিন্ন খাতের কর রেয়াত তুলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, যার প্রতিফলন দেখা গেছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে।
১০ বিলিয়ন ডলারের ফ্রেইট বিলের বড় অংশই যাচ্ছে বিদেশে
অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল বাংলাদেশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট আমদানি ছিল ৬৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি এবং রপ্তানি করেছে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের, যার ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীরগতির মধ্যেও মোট বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৮ বিলিয়ন ডলার।
এই বিপুল পরিমাণ বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি হয়েছে সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে। শিল্পসংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকরা ফ্রেইট চার্জ (জাহাজে মালবহনের ভাড়া) বাবদ ব্যয় করেছেন ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যার প্রায় ৯০ শতাংশই গেছে বিদেশি শিপিং কোম্পানিগুলোর কাছে।