রাশিয়ার ‘আন্ডারকভার’ ড্রোন যুদ্ধ: ‘হোম কল’, ছদ্মবেশ—আরও যত কৌশল

চলতি জুন মাসে ইউক্রেনের শহরগুলোর ওপর রাশিয়া ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনীর দাবি অনুযায়ী, একরাতেই তারা ৪৭২টি একমুখী হামলাকারী ড্রোন মোকাবিলা করেছে।
তবে এটিই হয়তো চূড়ান্ত রেকর্ড নয়। মে থেকেই ধারাবাহিকভাবে আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে। আর সম্প্রতি রাশিয়ার বিমানঘাঁটিগুলোতে ইউক্রেনের সফল ড্রোন হামলার পরে—রাশিয়ার প্রতিশোধমূলক আক্রমণ আরও তীব্র হচ্ছে।
এসব ড্রোন হামলার পেছনে রয়েছে রুশ সেনাবাহিনীর কয়েক বছরের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। শুরুতে তারা ইরান থেকে শাহেদ ড্রোন কিনলেও, ২০২৩ সাল থেকে রাশিয়া নিজস্ব কারখানায় সেগুলোর সংযোজন এবং পরে উৎপাদন শুরু করে। এর ফলে তারা উৎপাদন হার— সংখ্যায় বাড়াতে পেরেছে এবং ড্রোনে প্রয়োজনমতো প্রযুক্তিগত উন্নয়নও আনতে পেরেছে। রাশিয়ায় উৎপাদিত ড্রোনগুলোকে গেরান-২ নাম দেওয়া হয়েছে।
কীভাবে উন্নত করা হচ্ছে শাহেদ ড্রোনগুলো?
রাডারে ধরা না পড়ার জন্য ড্রোনের গায়ে কার্বনের প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে, যা রাডার তরঙ্গ শোষণ করে। এছাড়া সিম কার্ড ব্যবহার করে মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে রাশিয়ায় তথ্য পাঠানোর ব্যবস্থাও যুক্ত করা হয়েছে।
সম্প্রতি ড্রোনগুলোতে নতুন ধরনের ওয়ারহেড ব্যবহার করা হয়েছে—যা আগুন লাগাতে পারে (ইনসেন্ডিয়ারি বা দাস্য পদার্থবাদী) এবং বিস্ফোরিত হলে বহু সংখ্যক শার্পনেল ছড়িয়ে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়ায়। এসব পরিবর্তন প্রযুক্তিগতভাবে জটিল নয়, বরং এর উদ্দেশ্যই হচ্ছে খরচ নিয়ন্ত্রণে রেখে কার্যকারিতা বাড়ানো।
এই কম খরচের কিন্তু দীর্ঘ-পাল্লার ড্রোনগুলো রাশিয়ার জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক। কারণ, তারা প্রতিমাসে শত শত ড্রোন পাঠাতে পারে—যা ধ্বংস হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই। বিপরীতে ইউক্রেনের জন্য প্রতিটি ড্রোন আটকানো ব্যয়বহুল ও কঠিন কাজ।
নকল ড্রোন: নতুন কৌশল
সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ারহেডবিহীন রাশিয়া ভুয়া শাহেদ ড্রোন— কিন্তু এগুলো দেখতে আসল ড্রোনের মতোই। ইউক্রেনে সেগুলোকে পাঠানোও হচ্ছে। এদিকে আক্রমণ ঠেকাতে ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রতিটি ড্রোনকেই গুলি করে নামাতে হয়। ফলে তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ড্রোন ধ্বংসকারী মূল্যবান গোলাবারুদের খরচও বাড়ছে। মে মাসের শেষদিকে ইউক্রেন জানিয়েছে, রাশিয়ার পাঠানো ড্রোনগুলোর মধ্যে ৪০ শতাংশই ছিল ভুয়া।
৪৭২টি ড্রোন ছোড়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়া তাদের সবশেষ উদ্ভাবন ও কৌশল একত্রে প্রয়োগ করেছে—কার্বন লেপ, নতুন ওয়ারহেড, তথ্য পাঠানোর প্রযুক্তি এবং নকল ড্রোন সবই এর মধ্যে ছিল।
ইউক্রেনের জন্য চ্যালেঞ্জ কী?
ইউক্রেন এসব ড্রোনের বেশিরভাগই ধ্বংস করতে পারছে। যেমন ১ জুন রাতে ৪৭২টির মধ্যে ৩৮২টি গুলি করে নামানো হয়েছে—প্রায় ৮১% সফলতা। কিন্তু এত উচ্চহারে ড্রোন ধ্বংস করেও ইউক্রেন 'ব্যয়সাপেক্ষ প্রতিরক্ষা' সমস্যায় পড়ছে।
এই ড্রোন ঠেকাতে ইউক্রেনকে অসংখ্য মোবাইল ইউনিট, কাস্টমাইজড ড্রোন এবং ছোট পাল্লার অস্ত্র মোতায়েন করতে হচ্ছে—যেগুলোর সংখ্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক।
এদিকে ইউক্রেন রাশিয়ার ড্রোন কারখানায় হামলার চেষ্টা করছে। তবে এক্ষেত্রে তাদের সাফল্য সীমিতই।
সামরিকভাবে শাহেদগুলো হয়তো যুদ্ধের ফল নির্ধারণ করছে না, কিন্তু প্রতিনিয়ত আক্রমণ করে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিঃশেষ করার কৌশল নিচ্ছে রাশিয়া। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় ইউক্রেনের কাছে প্রতিটি অস্ত্রই এখন মূল্যবান।
এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র কিন্তু নির্বিচারে চলতে থাকা ড্রোন আক্রমণ—বড় পরিণতি তৈরি করতে পারে।
রাশিয়ার জন্যও ঝুঁকি আছে
তবে ইউক্রেনও পাল্টা ড্রোন হামলা শুরু করেছে—'স্পাইডারওয়েব' নামে অপারেশনের মাধ্যমে তারা রাশিয়ার সামরিক বিমানঘাঁটি ও জ্বালানি অবকাঠামোয় হামলা চালিয়েছে।
এদিকে শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও এই ড্রোন রণনীতি উপযোগিতা আছে, আর মস্কো সেটার সুযোগও কাজে লাগাচ্ছে। যেমন, গত ৯ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় দিবসে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে শাহেদ ড্রোন সামরিক কুচকাওয়াজে প্রদর্শন করা হয়—যেটা এর আগে কখনো হয়নি।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আক্রমণের মাত্রা আরও তীব্র হবে। ভ্লাদিমির পুতিন স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, ড্রোন যুদ্ধ আরও বিস্তৃত হবে।
যতদিন যুদ্ধ চলবে, ইউক্রেনের শহরগুলোকে বারবার ড্রোন হামলা ঠেকাতে হবে—এবং একই সঙ্গে রাশিয়াকেও নিজেদের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে ইউক্রেনের নাশকতামূলক ড্রোন হামলা মোকাবিলা করতে হবে। যুদ্ধ এখন এমন এক ধাপে পৌঁছেছে, যেখানে দুই পক্ষই একে অপরকে 'শক্তিক্ষয়ের' মাধ্যমে পরাজিত করতে চায়—ড্রোন যেখানে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।