আমেরিকায় অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া এশীয় শিক্ষার্থীরা কেমন আছে

অভিবাসী বাংলাদেশি পিতামাতার সন্তান ১৭ বছরের তৌসিফা হক। নিউইয়র্কের ব্রোঙ্কস এলাকায় থাকেন পরিবারের সাথে। শহরের এক সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাসে যোগ দিতে রোজ সাবওয়ের ট্রেনে চেপে দক্ষিণ ব্রুকলিনে যান। এই যাত্রায় সময় লাগে দেড় ঘণ্টা।
তৌসিফা পড়ছেন ব্লুকলিন টেকনিক্যাল হাইস্কুলে। এই স্কুলে রয়েছে নানান জাতি ও বর্ণের শিক্ষার্থী; বাঙালি থেকে তিব্বতী বা চীনা, সিংহলী, রাশিয়ান,আফ্রিকান আমেরিকান,ডোমিনিকান - আছে সবারই সম্মিলিন।
বিশাল আটতলা স্কুল ভবনে একসাথে ক্লাস করতে পারে ৫,৮৫০ শিক্ষার্থী। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় উচ্চ বিদ্যালয়, পড়াশোনার মানের জন্যও সুপরিচিত।
তৌসিফার বাবা একজন ট্যাক্সিক্যাব চালক। লাঞ্চরুম অ্যাটেনডেন্টের কাজ করেন তার মা। তাই এমন মানসম্পন্ন স্কুলে তৌসিফার শিক্ষাগ্রহণ পরিবারটির কাছে যেন স্বপ্নপূরণের পথ।
তৌসিফা তা স্বীকার করে বলেন, "এটা আমার জন্য সুবর্ণ সুযোগ। (অভাব-অনটন থেকে) মুক্তি পাওয়ার পথ।"
অথচ এই স্বপ্নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্রুকলিন টেকনিক্যাল প্রতিনিয়ত কিছু কারণে সমালোচনার শিকার। আমূল কিছু সংস্কারের দাবিও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। শুধু এটিই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আরও অনেক সরকারি হাইস্কুলের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

যুক্তরাষ্ট্রের উদারমনা রাজনীতিক, স্কুলের তরুণ নেতৃত্ব ও তাদের সংগঠনগুলোর মতে, বিখ্যাত সরকারি স্কুলগুলো হয়ে উঠেছে অভিজাত-তন্ত্রের আখড়া। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিন আমেরিকানরা খুব কমই ভর্তির সুযোগ পায়। যেমন ব্রুকলিন টেকনিক্যালে তাদের সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৫ শতাংশ।
এশীয় ছাত্ররা সেদিক থেকে এগিয়ে। ব্রুকলিন টেকনিক্যালে তাদের সংখ্যা ৬১ শতাংশ। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যায় তাদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ১৮ শতাংশ।
কিছু সমালোচকের দাবি, হাইস্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষিণ ও পূর্ব এশীয় শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য থাকায় লাতিন ও কৃষ্ণাঙ্গরা সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে, যা স্রেফ অন্যায়ের শামিল।
মাঝেমধ্যেই এসব সমালোচনার পারদ তুঙ্গে ওঠে, জন্ম দেয় উত্তেজনার। যেমন কয়েক বছর আগে স্কুল কাউন্সিলের একজন গণ্যমান্য শ্বেতাঙ্গ সদস্য বলেছিলেন, এ ধরনের স্কুলে 'বর্ণচেতনার জাগরণ দরকার!'
গেল বছর পর্যন্ত নিউইয়র্ক স্কুল চ্যাঞ্চেলর পদে ছিলেন রিচার্ড ক্যারেঞ্জা। তিনি আরও বিতর্কিত মন্তব্যের মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেন। তিনি বলেছিলেন, "মানসম্পন্ন সরকারি স্কুলে যে কোনো বর্ণের শিক্ষার্থীকে ভর্তির সমান সুযোগ দেওয়ার যুক্তি আমি মানতে পারি না।"
ব্রুকলিন টেকনিক্যালে পড়ুয়া এশীয় ও কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের থেকে নেওয়া বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে স্কুল শিক্ষার এই বর্ণবাদী রাজনীতিকরণের গভীর প্রভাব উঠে এসেছে, যা শুধু নিউইয়র্কে নয় পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে অনুভূত হচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজনীতির ঘিরে তাদের উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের কথা জানান। বিভিন্ন প্রত্যাশার কথাও তুলে ধরেছেন। যেমন এশীয় শিক্ষার্থীরা আরও বেশি সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিন সহপাঠি চান।
ব্রুকলিন টেকনিক্যালে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৬৩ শতাংশই হলেন সমাজে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণিভুক্ত। নানান জরিপে দেখা গেছে, নিউইয়র্ক মহানগরবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে কম আয়কারী হলেন এশীয়রা। তাদের অধিকাংশই বাড়িতে নিজ মাতৃভাষায় কথা বলেন।
এজন্য তারা অন্য বঞ্চিত শ্রেণির ব্যাপারেও বেশি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন।
তবে শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়ে বিতর্ক শুধু নিউইয়র্কের নির্দিষ্ট কিছু বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক শিক্ষাঙ্গন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে সংশ্লিষ্টদের। বর্ণবাদী বৈষম্য কমাতে পদক্ষেপও দিচ্ছে অনেক অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ।
যেমন সান ফ্রান্সিন্সকোর শিক্ষাবোর্ড শিক্ষামানে সুপরিচিত লোয়েল হাইস্কুলে মেধাভিত্তিক ভর্তি ব্যবস্থা বাতিল করে লটারি-ভিত্তিক ব্যবস্থা চালু করেছে। এই বিদ্যালয়ে ৫৫ শতাংশ ছাত্রই হলো এশীয়। এব্যাপারে বোর্ডের একজন সদস্যের মন্তব্য, "প্রতিষ্ঠিত পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা যখন মেধা যাচাইবাছাইয়ের কথা বলি তখন আসলে বর্ণবাদী ব্যবস্থাকে সমর্থন দেই।"
শিক্ষাবোর্ডটির এমন সিদ্ধান্তের কারণ আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের সন্তানদের পক্ষে তাল মিলিয়ে শিক্ষাগত দক্ষতা অর্জন করা বেশ কঠিন। এজন্য তারা ভালো স্কুলে ভর্তি হতে পারে না।
ফেয়ারফ্যাক্স কাউন্টির শিক্ষা কর্মকর্তারা আরেকটি সুপরিচিত বিদ্যালয়- থমাস জেফারসন হাইস্কুল ফর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে গ্রেড ও ভর্তিচ্ছুদের আর্থ-সামাজিক শ্রেণি বিবেচনা এই দুইয়ের মিলিত বাছাই প্রক্রিয়া চালু করেন। এই ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরের বছরই কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিন ছাত্রদের সংখ্যায় দেখা যায় বড় উল্লম্ফন। আর মধ্য ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত এশীয় ছাত্রদের শতকরা হারও হ্রাস পায়। তবে সার্বিকভাবে ছাত্র ভর্তি বেড়ে যায়।
এনিয়ে এশীয় অভিভাবকরা আদালতে মামলা করেন। অভিযোগ শুনানির পর একজন ফেডারেল বিচারক তাদের আইনজীবীকে বলেন," ব্যবস্থাটি বর্ণ-নিরপেক্ষ নয়, আর তাতে শিক্ষার্থী সংখ্যায় বর্ণ-কাঠামো পরিবর্তিত হবে সেটাও অজানা নয়।"
মামলাটির এখনও রায় ঘোষণা করা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের মানসম্পন্ন সরকারি স্কুলে পড়ার রয়েছে অনেক সুবিধা। ব্রুকলিন টেকনিক্যালও পড়ে সেই কাতারে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বিষয়টি ভালো করেই জানেন। তবে তাদের ভর্তি ব্যবস্থা বর্ণবাদী দোষে দুষ্ট এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অনেকেই।
অশ্বেতাঙ্গদের প্রাধান্য থাকায় তার বিদ্যালয়ের ভর্তি ব্যবস্থাকে বর্ণবাদী বলা যায় কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত নন তৌসিফা হক।
তার মতে, "সব জাতি ও বর্ণের শিক্ষার্থীর সাথে আমি ক্লাস করি। বিভিন্ন ভাষাভাষি আমার অনেক বন্ধু রয়েছে। একে বর্ণবাদী বলাটা বোধগম্য হয় না।"
বিষয়টির ব্যাখ্যা করেন মিশর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা একজন অভিবাসী ও ব্রুকলিন টেক থেকে স্নাতক করা একজন সাবেক শিক্ষার্থী সালমা মোহাম্মদ। তিনি বলেন, "যেসব স্কুলে এশীয়দের প্রাধান্য শুধু সেগুলোর ভর্তি ব্যবস্থাকেই বর্ণবাদী বলা হচ্ছে। এটি আসলে শ্বেতাঙ্গ ও সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির অসন্তোষের মনোভাব। কিন্তু, আমরা তাদের সাথে একমত নই।"
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস