যুদ্ধ এড়ানোর দায়িত্বে ইরানের সবচেয়ে ‘কৌশলী কূটনীতিক’!

ইরানের অভিজ্ঞ শীর্ষ কূটনীতিক আব্বাস আরাকচি এবার এক অতি সংবেদনশীল দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন। তিনি এই সপ্তাহান্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন। আলোচনার লক্ষ্য, একটি নতুন পারমাণবিক চুক্তি অর্জন এবং দেশটির ওপর সম্ভাব্য সামরিক হামলা ঠেকানো।
এই আলোচনায় ইরানের ধর্মীয় নেতৃত্ব অত্যন্ত সতর্কভাবে অংশ নিচ্ছে। ওমানে অনুষ্ঠেয় বৈঠক ঘিরে তাদের প্রত্যাশা সীমিত। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে রয়েছে গভীর সন্দেহ। তিনি বারবার বলেছেন, চুক্তি না হলে তিনি বোমা বর্ষণ করবেন।
আলোচনা সরাসরি হবে কি না, যেমনটা ট্রাম্প দাবি করছেন; নাকি পরোক্ষভাবে, যেমনটা তেহরান জোর দিয়ে বলছে–সেটিই এখন প্রশ্ন। তবে যেভাবেই হোক, আরাকচির মুখোমুখি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের দূত স্টিভ উইটকফ। তিনি একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী , যার পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই; ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম ঘিরে দীর্ঘদিনের জটিল বিরোধের মতো বিষয়ে তো নয়ই।
এই পরিস্থিতিতে আরাকচির জন্য চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। ইসফাহানের একটি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান তিনি। কিশোর বয়সে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৯৮০-এর দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এরপর শুরু হয় তার চমকপ্রদ কূটনৈতিক পথচলা।
যদিও তেহরানে এই আলোচনা নিয়ে খুব বেশি আশাবাদ নেই, তবু রাজনৈতিক নেতৃত্ব আরাকচির কৌশলী ও বিচক্ষণ ভূমিকার ওপর ভরসা রাখছে। ইরানের পক্ষ থেকে আলোচনায় নিজের চালটি তিনি দক্ষ হাতে খেলতে পারবেন বলেই তাদের বিশ্বাস।
ইরানের বিশ্লেষক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি সাঈদ লেইলাজ মন্তব্য করেন, 'ঠিক সময়ে, ঠিক জায়গায় ঠিক মানুষটাই হচ্ছেন আরাকচি।'
সাঈদ বলেন, 'তিনি (আরাকচি) ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সর্বোচ্চ নেতার পূর্ণ আস্থা ও অনুমোদন রয়েছে তার প্রতি। আর পারমাণবিক ইস্যুর প্রতিটি দিক সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান রয়েছে।'
ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান গত বছর তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেন। শান্ত স্বভাবের এই কূটনীতিক ২০১৫ সালে পারমাণবিক চুক্তির পথ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়ে কঠিন দরকষাকষির দক্ষ খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
ইরান ও ছয়টি বিশ্বশক্তির মধ্যকার আলোচনায় অংশ নেওয়া পশ্চিমা কূটনীতিকরা আরাকচিকে বর্ণনা করেছেন 'গম্ভীর, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন এবং স্পষ্টভাষী একজন কূটনীতিক' হিসেবে।
এই চুক্তিতে ইরান তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিতে সীমা আরোপের বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই চুক্তি বাতিল করে দেন এবং আবারও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
আরাকচি ছিলেন সেই মুখ্য প্রতিনিধি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ২০২১-২৫ মেয়াদে চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করতে উদ্যোগ নেওয়া পরোক্ষ আলোচনার নেতৃত্ব দেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। এরপরই তাকে সরিয়ে দিয়ে একজন কট্টরপন্থী, পশ্চিম-বিরোধী নেতাকে তার স্থানে আনা হয়।
এর কিছুদিন পরই আরাকচিকে ইরানের কৌশলগত পররাষ্ট্র পরিষদের সচিব করা হয়। এই পরিষদ সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে পরামর্শ দেয়, যা তাকে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মহলের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
কে এই আব্বাস আরাকচি?
১৯৬২ সালে তেহরানে এক ধনী ধর্মপরায়ণ ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নেন আরাকচি। যখন তার বয়স মাত্র ১৭, তখন ইসলামি বিপ্লব ইরানে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের বহু তরুণের মনে উগ্র আদর্শের জোয়ার তোলে।
যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত শাহ-এর রাজতান্ত্রিক শাসনের পতন এবং নতুন এক ভবিষ্যতের আকর্ষণে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ইসলামি রেভ্যুলশনারি গার্ড বাহিনীতে যোগ দেন। ইরানের সামরিক অগ্রভাগে থাকা এই বাহিনীর সদস্য হয়ে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সালের রক্তক্ষয়ী ইরান-ইরাক যুদ্ধে অংশ নেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৮৯ সালে আরাকচি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। এরপর ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি ফিনল্যান্ডে এবং ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জাপানে ইরানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিযুক্ত হন।
তিনি ব্রিটেনের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ২০১৩ সালেই তাকে উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ইসলামি বিপ্লবের আদর্শে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে আরাকচি এমন সব প্রেসিডেন্টের অধীনে কাজ করেছেন, যাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কখনও বাস্তববাদী, কখনও কট্টরপন্থী।
তার পুরো কর্মজীবন জুড়েই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি দেশটির বৈদেশিক সম্পর্ককে অনেকাংশে সংজ্ঞায়িত করেছে। ইরান বরাবরই বলেছে, এই কর্মসূচি পুরোপুরি বেসামরিক উদ্দেশ্যে চালু রয়েছে। কিন্তু অনেক পশ্চিমা দেশ মনে করে, এর আড়ালে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছে।
তেহরানে তার খ্যাতি তাকে অভ্যন্তরীণ সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে, যদি না ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ছাড় দিতে হয়।
রাজনৈতিক অন্দরমহলে গভীর সম্পর্ক থাকার পরও, খামেনির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সত্ত্বেও, আরাকচি 'রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং দলগত সংঘর্ষ' থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন একজন জ্যেষ্ঠ ইরানি কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'তার সর্বোচ্চ নেতা, বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এবং ইরানের সব রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে।'