ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করল ইরান

ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে রুজবেহ ভাদি নামের এক পরমাণু বিজ্ঞানীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইরান। বুধবার এই সাজা কার্যকর করা হয় বলে জানিয়েছে দেশটির বিচার বিভাগের মুখপাত্র সংস্থা মিজান।
মিজানের খবরে বলা হয়, রুজবেহ ভাদি ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন এবং সেখানকার স্পর্শকাতর তথ্য ও গোপন নথিতে তার সরাসরি প্রবেশাধিকার ছিল—যার খোঁজ করছিল ইরানের শত্রুরা। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কাছে এসব গোপন তথ্য সরবরাহ করতেন এবং গত জুন মাসে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ চলাকালে মোসাদের এক অভিযানে অপর এক ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীর হত্যায় সহায়তা করেছিলেন।
বিচার বিভাগ জানায়, ভাদির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় এবং আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে তার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।
গত জুনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এটাই দেশটির প্রথম উচ্চপ্রোফাইল ফাঁসি কার্যকর। ওই যুদ্ধে ইসরায়েল অন্তত ৩০ জন শীর্ষ ইরানি সামরিক কর্মকর্তা ও ১১ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছিল।
ইরানি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, যুদ্ধের প্রথম রাতেই ইসরায়েল দেশটির নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাঠামোয় ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং ভেতর থেকেই ড্রোন হামলা চালিয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ড অবকাঠামোর বড় অংশ ধ্বংস করে দেয়।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেশজুড়ে একাধিক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের জন্যও ইসরায়েলকে দায়ী করেছেন ইরানি কর্মকর্তারা। দেশটির ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চললেও এবার ভেতরে প্রবেশ করে অত্যন্ত নির্ভুল ও সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে চালানো অভিযানে বিস্মিত ইরানি প্রশাসন।
যুদ্ধ শেষে সারা দেশে শুরু হয় ধরপাকড়। 'গোয়েন্দাগিরি' ও 'জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি' সন্দেহে শত শত মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। ইরানি গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সমাজকর্মী, ভিন্নমতাবলম্বীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ রয়েছেন।
ইরানে কোনো পরমাণু বিজ্ঞানীর গ্রেফতার ও ফাঁসি কার্যকরের ঘটনা অত্যন্ত বিরল। দেশটি তাদের পরমাণু কর্মসূচিকে জাতীয় গর্ব হিসেবে তুলে ধরে এবং বিজ্ঞানীদের 'জাতির নায়ক' হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে এই ঘটনা ইরানের জন্য বড় একটি লজ্জার বিষয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ, এতে বোঝা যায় মোসাদ ইরানে কতটা গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে।
গত সপ্তাহেই ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহে ২০ জন গুপ্তচরকে গ্রেফতার করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, জুনের যুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইরান কমপক্ষে ১০ জনকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে—যাদের একজন ভাদি।
তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এই মৃত্যুদণ্ড কিংবা ভাদির সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। একইভাবে, ভাদির পরিবারের কেউ বা তার আইনজীবীও গণমাধ্যমে কিছু জানাননি। এমনকি ফাঁসি কার্যকরের আগে ইরান সরকার তার গ্রেফতারের বিষয়টিও প্রকাশ করেনি।
মঙ্গলবার ইরানের প্রধান বিচারপতি গোলাম-হোসেইন মোসেনি-এজেই বলেছেন, 'দেশে গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং গ্রেফতারকৃতদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।' ইরানের সরকারি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তার বক্তব্যে আরও বলা হয়, 'গোয়েন্দাদের শনাক্ত করতেই হবে, কিন্তু সেটা সহজ কাজ নয়। রাস্তায় হেঁটে চলা কাউকে ধরে এনে তো গোয়েন্দা ধরা যায় না। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাকেই তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তবে সেটা অবশ্যই ন্যায্য ও যথাযথ বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হতে হবে।'
এদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ইরান বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। চলমান ধরপাকড়কে সরকারবিরোধী মত দমনের একটি হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তারা।
ইরানে যেসব মামলায় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়, সেগুলোর বিচারপ্রক্রিয়া সাধারণত গোপনীয়তার মধ্যে রেভল্যুশনারি কোর্টে সম্পন্ন হয়—যেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
এর আগেও এমন কয়েকটি উচ্চপ্রোফাইল মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালে ইরান পারমাণবিক বিজ্ঞানী শাহরাম আমিরিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ফাঁসি দেয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়েছিলেন, পরে দেশে ফিরে এলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আমিরির দাবি ছিল, হজ পালনের সময় সৌদি আরব থেকে তাকে অপহরণ করে যুক্তরাষ্ট্র।
২০২৩ সালে ইরান আলিরেজা আকবারি নামের একজন সাবেক উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে ফাঁসি দেয়। অভিযোগ ছিল, তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন এবং পশ্চিমাদের কাছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির গোপন তথ্য ফাঁস করেছেন। তার ফাঁস করে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই যুক্তরাষ্ট্র গত জুনে ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়।
এছাড়া বুধবার একই সঙ্গে আরও এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইরান। তার নাম মেহদি আসগারজাদে। বিচার বিভাগ জানিয়েছে, তিনি ইসলামিক স্টেট (আইএস) সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য ছিলেন। ইরাক ও সিরিয়ায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তিনি ইরানে প্রবেশ করেন সন্ত্রাসী হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বুধবার ভাদির 'স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও' প্রচার করেছে, যেখানে তাকে নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ স্বীকার করতে দেখা যায়। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, ইরান বন্দিদের কাছ থেকে জোরপূর্বক এ ধরনের স্বীকারোক্তি আদায় করে।
তেহরানের খ্যাতনামা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আমির কাবির ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন রুজবেহ ভাদি। অ্যালামনাই নেটওয়ার্কের দেওয়া তথ্যমতে, তিনি পারমাণবিক প্রকৌশলে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন, গবেষণার বিষয় ছিল রিঅ্যাক্টর। এরপর তিনি ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার অধীনস্থ পরমাণু বিজ্ঞানের অভিজাত গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
মিজানের খবরে আরও জানানো হয়, ভাদি মোসাদের সঙ্গে অনলাইনে যুক্ত হন এবং এরপর পাঁচবার অস্ট্রিয়ায় গিয়ে সংযোগকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কর্মস্থলের তথ্য ও কার্যক্রম সংক্রান্ত সাপ্তাহিক প্রতিবেদন তিনি ইসরায়েলে পাঠাতেন এবং এর বিনিময়ে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে অর্থ পেতেন। তবে ওই অর্থের পরিমাণ জানানো হয়নি।