এ মাসেই জাপানি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হতে পারে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ চুক্তি

বাংলাদেশের আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হওয়ার স্বপ্ন এখন অনেকটাই বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে। কারণ কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চূড়ান্ত চুক্তি এ মাসেই স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে।
অনুমোদনের পাঁচ বছর পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) আগামী ২২ এপ্রিল ঢাকায় জাপানের দুই খ্যাতনামা নির্মাণ ও প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান—পেন্টা-ওশান লিমিটেড এবং টিওএ কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিপিএ-র সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক।
এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকার প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০২৯ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
বন্দরটি চালু হলে বড় আকারের জাহাজগুলো সরাসরি নোঙর করতে পারবে। এ সুবিধা বর্তমানে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামেও নেই। বন্দর কর্মকর্তারা জানান, এতে করে জাহাজ চলাচলের সময় ও খরচ উভয়ই উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
'এটি একটি বড় অগ্রগতি। জাইকার তত্ত্বাবধান ও অনুমোদনের আওতায় প্রকল্পটি এগিয়ে চলছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই নির্মাণকাজ শুরু হবে এবং আমরা আশা করছি, ২০২৯ সালের মধ্যেই বন্দরটি চালু করা যাবে,' টিবিএসকে বলেন ওমর ফারুক।
বন্দরের ধারণক্ষমতা বাড়ছে
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ ১০ মিটার গভীরতার (ড্রাফট), ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার জাহাজ চলাচল করতে পারে। এর তুলনায় মাতারবাড়ি বন্দরের প্রথম পর্যায়েই ১৬ মিটার গভীরতার জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা থাকবে।
কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা, গভীর সমুদ্রবন্দরটি চট্টগ্রামের তুলনায় জাহাজ পরিবহনে খরচ ৫৭ শতাংশ এবং সময় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনবে।
প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই এবং জমি অধিগ্রহণ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। পাশাপাশি, জাপানের দুটি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। আর তৃতীয় পর্যায়ে টাগবোট ও পাইলট বোটের মতো প্রয়োজনীয় নৌযান সংগ্রহ করা হবে।
পণ্য পরিবহন সহজতর করতে সড়ক ও জনপথ বিভাগ গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযোগকারী ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের সঙ্গে একীভূতকরণ
মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট (১,২০০ মেগাওয়াট) বাস্তবায়ন গভীর সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা ও অন্যান্য উপকরণ পরিবহনের জন্য ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নেভিগেশনাল চ্যানেল নির্মাণ করা হয়, যা এখন বন্দর ব্যবস্থাপনায় পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ১৬১টি জাহাজ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে নোঙর করেছে এবং মোট ৩ দশমিক ২৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করেছে।
বর্তমানে এক টিইইউ (টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কনটেইনার পরিবহনে গড়ে ৩ হাজার ডলার খরচ হয় এবং ইউরোপে চালান পৌঁছাতে ৪০ থেকে ৪২ দিন সময় লাগে। কিন্তু গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে ৮ হাজার ২০০ টিইইউ ধারণক্ষমতার বড় কনটেইনার জাহাজগুলো সরাসরি নোঙর করতে পারবে। এতে করে ডেলিভারির সময় ১৬ থেকে ১৭ দিন কমে আসবে এবং খরচ নেমে আসবে ১ হাজার ৩০০ ডলারের নিচে।
'বন্দরটি চালু হলে ভারতের কলকাতা ও হলদিয়া বন্দর থেকে ফিডার জাহাজে করে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। এ ট্রান্সশিপমেন্ট কাঠামোর মাধ্যমে ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে পণ্য পরিবহন আরও দক্ষ হবে এবং এতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে,' বলেন বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন।
একটি আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট হাব
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে এটি কেবল বড় আকারের জাহাজই ধারণ করতে পারবে না, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবেও কাজ করবে।
'প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের পণ্য পরিবহনের জন্য এ বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। তাছাড়া, ইউরোপ বা আমেরিকাগামী বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজগুলোর আর সিঙ্গাপুর, কলম্বো বা মালয়েশিয়ার মাধ্যমে ফিডার ভেসেল ট্রানজিটের প্রয়োজন পড়বে না,' তিনি বলেন।
প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি
মাতারবাড়ি বন্দর প্রকল্পটি ২০২০ সালে পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনুমোদিত হলেও ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত জটিলতা ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জের কারণে বিলম্বিত হয়।
২০২৪ সালের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটির ব্যয় সংশোধন করে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা নির্ধারণ করে। এতে মার্কিন ডলারের বাড়তি মূল্য ও অন্যান্য আর্থিক কারণে ৬ হাজার ৫০০ কোটিরও বেশি অতিরিক্ত ব্যয় সমন্বয় করা হয়েছে।