নিউমার্কেটের ওডিসি-নামা!

ঢাকা শহরে থাকার জন্য প্রথম আসা ২০১৯ সালে। উদ্দেশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং। ফার্মগেটের এক ঘুপচি গলিতে মেস বাসা। একদিন নতুন কাপড় কেনার জন্য রওনা হলাম নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে। ঢাকা আসার আগেই শুনেছিলাম, ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে ভালো ভালো কাপড় বিক্রি হয়।
মেস থেকে বের হয়ে রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম, ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে নিয়ে যেতে। মামা জিজ্ঞাসা করলেন, 'ওডিসি?' প্রথমে মনে হলো ভুল শুনলাম কি না।
হোমারের মহাকাব্য 'ওডিসি' কীভাবে ঢাকা কলেজের বিপরীতে এল- সেদিন এ নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই রিকশায় উঠে বসেছিলাম। এরপরে ঢাকা শহরে কেটেছে অনেকগুলো বছর। ঢাকা কলেজের বিপরীত অংশকে সেদিন রিকশাওয়ালা মামা কেন ওডিসি বলেছিলেন, সেই রহস্যের মীমাংসা হয়েছে অনেকদিন আগেই। ঢাকা কলেজের বিপরীত কথাটার ইংরেজি করলে হয়- অপোজিট অব ঢাকা কলেজ। এটাকেই ছোট করে নাম দেওয়া হয়েছে- 'ওডিসি'।
ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে অনেক মার্কেট আছে। সব মার্কেটেরই আছে নিজস্ব নাম। নেহার ভবন শপিং সেন্টার, নূরজাহান সুপার মার্কেট, গ্লোব শপিং সেন্টার, গোল্ডেন গেট শপিং সেন্টার, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট আর লাটিমী শপিংমল। ঢাকা কলেজের বিপরীতে এসব মার্কেটের অবস্থান। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা কিংবা দোকানের কর্মচারী- সবাই এখানকার সব মার্কেটকে একসঙ্গে 'ওডিসি মার্কেট' বলেই ডাকেন।

মুখে মুখে প্রচলন
কবে থেকে এ মার্কেটগুলোর নাম একসঙ্গে ওডিসি হয়ে গেল, তা সঠিকভাবে কেউই জানেন না। ১৯৫৪ সালে প্রথম এই এলাকায় 'নিউমার্কেট'-এর গোড়াপত্তন হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের সরকার এ মার্কেট প্রতিষ্ঠা করেছিল। ঢাকাকে আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য 'নিউমার্কেট' অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিউমার্কেটের আশেপাশে আরও বিভিন্ন মার্কেট গড়ে ওঠে। একপাশে 'চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট' আর রাস্তা পার হলে 'চাঁদনী চক' ও 'গাউছিয়া'- নিউমার্কেটের পরে এ এলাকার হলি ট্রিনিটি ধরলে এ তিনটা মার্কেটই বেশি নজরে আসে। ক্রেতা সমাগমও বেশি।
মিরপুর সড়ক ধরে আরেকটু বামে এগোলেই 'ঢাকা কলেজ'। আর ঢাকা কলেজের বিপরীত মানেই ওডিসি। ওডিসির মার্কেটগুলোর নাম আগেই বলেছি। কিন্তু ওডিসি নামটা কীভাবে এল?
ঢাকা কলেজের ১৯৮১ ব্যাচের শিক্ষার্থী সেলিম হোসেন এ ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করে বললেন, 'আমরা যখন ঢাকা কলেজে ছিলাম, তখন এত বেশি মার্কেট ছিল না। যা কেনার নিউমার্কেট থেকেই কিনতাম। দুই-একটা মার্কেট হচ্ছিল তখন কলেজের উল্টো পাশে। আর ফুটপাতেও এত ভিড় থাকত না। ওডিসি নামটা আমরা অনেক পরে জেনেছি।'
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের থেকে নয়, বরং আশেপাশের অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীরা এ নামের প্রচলন ঘটান বলে মনে করেন ওডিসির ফুটপাতে বসা ব্যবসায়ী রবিউল মিয়া।

তিনি ৩০ বছর ধরে এ এলাকায় ব্যবসা করছেন। কখনো ভ্যান নিয়ে বসেন, কখনো ফুটপাতে বসে। তিনি বলেন, 'ঢাকা কলেজের পোলাপানের থেকে অন্য কলেজের কাস্টমার বেশি আমাদের। ইডেন কলেজ, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, নটরডেম কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এসব জায়গার পোলাপানরা বেশি আসে এখানে। ওরাই আসলে বলতে বলতে ঢাকা কলেজের উল্টা পাশটার নাম ওডিসি বানায়ে ফেলছে। এখন আমরাও ওডিসি-ই বলি।'
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নতুন কাপড় কেনার প্রথম পছন্দের জায়গা ওডিসি। কম দামে ভালো মানের কাপড় পাওয়া যায় এখানে। শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে দামাদামিও করা যায়। যার জন্য ওডিসিতে সবসময়ই ভিড় লেগেই থাকে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, ঢাকার সব এলাকা তো বটেই, সারাদেশ থেকেও ক্রেতারা আসেন এখানে।
যা পাওয়া যায়
ওডিসিতে কী পাওয়া যায়, এ প্রশ্ন থেকে বেশি ভালো প্রশ্ন হলো ওডিসিতে কী পাওয়া যায় না? শরীরে পরিধেয় সব ধরনের কাপড়ের সন্ধান মিলবে এখানকার মার্কেটগুলোয়। নবজাতক থেকে বয়োবৃদ্ধ- সব বয়সের মানুষের পোশাকই পাওয়া যায় এখানে। যেকোনো ট্রেন্ড শুরু হলে ব্র্যান্ডের দোকানের আগে সেগুলো পাওয়া যায় ওডিসির দোকানগুলোতে।
ওডিসি মূলত বিখ্যাত এক্সপোর্ট কাপড়ের জন্য। আমাদের দেশের অজস্র কাপড় তৈরির কারখানা বিদেশে কাপড় রপ্তানি করে। এসব কারখানা থেকে শতভাগ নিখুঁত কাপড়গুলোই রপ্তানি করা হয় বিদেশে। কিন্তু কারখানায় তৈরি সব কাপড় তো আর নিখুঁত হয় না। কিছু কিছু কাপড়ে ছোট ফুটা থাকে, আবার কিছু কাপড়ে থাকে রঙের সমস্যা। এ ধরনের কাপড়গুলোকে গার্মেন্টের ভাষায় বলা হয় 'স্টক লট' আর ওডিসির ভাষায় 'রিজেক্টের কাপড়'।
ওডিসির বেশিরভাগ দোকানে এসব রিজেক্টের কাপড় নিয়ে আসা হয়। এই কাপড়গুলোই এক্সপোর্টের কাপড় নামে বিক্রি হয়। কিন্তু তাই বলে যে এগুলো বাতিল বা কম মানের কাপড় থাকে, এমন না। রিজেক্টের চিহ্ন অনেক ভালো মতো খুঁজলে হয়তো পাওয়া যায়। অনেক সময় খুঁজেও পাওয়া যায় না অভিজ্ঞ চোখ না থাকলে।
যার ফলে যেই রপ্তানি করা জিন্সের প্যান্ট ইউরোপ বা আমেরিকায় ২০ থেকে ২৫ ডলারে বিক্রি হয়, ওডিসিতে তা পাওয়া যায় ৪০০ থেকে ৭০০ টাকায়। ওডিসিতে আরও পাওয়া যায় ছেলেদের ফরমাল আর ক্যাজুয়াল শার্ট, গেঞ্জি, পাঞ্জাবি, প্যান্ট, হাফ প্যান্ট, শর্ট প্যান্ট। মেয়েদের জামা, ফ্রক, প্যান্ট, গাউন, থ্রিপিস, টু পিস ইত্যাদি। স্যুট, বেল্ট, টাই, জুতাও পাওয়া যায় বিভিন্ন দোকানে।

অনেকে আবার আসে কাপড় অল্টার বা রিফু করানোর জন্য। কিছু দোকানের ঠিক বাইরের সারি সারি সেলাই মেশিন নিয়ে বসে থাকেন পেশাদার দর্জি। তাদেরকে বলা হয় 'ওডিসি মাস্টার'। এখান থেকে কেনা কোনো কাপড় যদি চাপা হয় বা ঢিলা হয়, তবে এসব দর্জিদের কাছে গেলেই হয়। ৫০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যেই চোখের পলকে কাপড়ের সেলাই খুলে পছন্দের সাইজ অনুযায়ী নতুন করে সেলাই করে দেন তারা।
এছাড়াও পাওয়া যায় সকল বয়সের শিশুদের কাপড়। কাপড় ছাড়াও টুকিটাকি নানা গৃহস্থালি পণ্যের পসরা নিয়ে ফুটপাতে বসেন বিক্রেতারা। ঘর সাজানোর পণ্য, প্রসাধনী, গয়না, ব্যক্তিগত গাড়িতে রাখার নানা শো-পিস- এগুলোও পাওয়া যায়। কেনাকাটা করতে করতে ক্ষুধা লাগলে ক্রেতাদের জন্য আছে নানারকম মুখরোচক স্ট্রিট-ফুডের সমারোহ। ঝালমুড়ি, ভেলপুড়ি, আমড়া, শসা, স্যুপ, নুডলস, সোডা- কী নেই এখানে!
ওডিসির জিনিসগুলোর দাম সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে শুরু। হাজার-দু'হাজার পর্যন্ত দামের জিনিসও পাওয়া যায় এখানে। কোনো নির্দিষ্ট দাম নাই কোনো পণ্যেই। যে যেভাবে দামাদামি করে কিনতে পারে বা বেচতে পারে- তাতেই লাভ। তার উপরে ঢাকা কলেজ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দিলে মিলে বিশেষ ডিসকাউন্ট।
ওডিসির মার্কেটগুলোর দোকান থেকে ফুটপাতের দোকানে বেশি ক্রেতার সমাগম দেখা যায়। চলার পথে হাঁটতে হাঁটতে নানারকম বাহারি পণ্যের সমাহার দেখে যে কেউই এগিয়ে যায় ফুটপাতের এই দোকানগুলোর দিকে। ফুটপাতে টেবিলের ওপরে একগুচ্ছ কাপড় থেকে বেছে বেছে কাপড় পছন্দ করেন ক্রেতারা। গায়ের সঙ্গে কাপড় লাগিয়ে আন্দাজে সাইজ বুঝে, দামাদামি করে কিনে নেন কাপড়।
তবে ফুটপাতের দোকানগুলো বৈধভাবে বসে না। বিভিন্ন সময়ে পুলিশ রেইড দিয়ে দোকানগুলো উঠিয়ে দেয়। কয়দিন পরেই তারা আবার দোকান নিয়ে বসে রাস্তার পাশে।
রবিউল মিয়া বলেন, 'ফুটপাতেই আমাদের রুটি-রুজি। আমরা তো কারো ক্ষতি করতেছি না এখানে ব্যবসা করে। যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের লোকরে আমাদের চাঁদা দেওয়া লাগে। আবার পুলিশও কয়দিন পরপর উঠায়ে দেয়। দোকান দেওয়ার জায়গা আর সামর্থ্য থাকলে তো আমরা এখানে বসতাম না।'
ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় বৃষ্টির মৌসুমে। খোলা আকাশের নিচে পণ্য নিয়ে বসেন তারা। আকাশে একটু মেঘ দেখা দিলেই ছুটোছুটি করে ছাতা আর পলিথিন যোগাড় করতে হয়। আর হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামলে ভিজে যায় বিক্রির পণ্য।

উৎসব আর বিড়ম্বনা
দুই ঈদের সময়ে ওডিসি এলাকায় চলে রমরমা ব্যবসা। নিউমার্কেট এলাকা সাধারণত মঙ্গলবার বন্ধ থাকলেও, ঈদের সময় সপ্তাহের সাতদিনই খোলা থাকে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে শুরু করে রাত দু'টো-তিন'টে অব্দি থাকে ক্রেতাদের সমাগম। এ সময়ে ওডিসি এলাকায় আর ফুটপাতে এত বেশি ভিড় হয় যে পা ফেলে হাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। অনেকে ভীড়ের মধ্যে সঙ্গী বা বাচ্চাকে হারিয়ে ফেলেন- এমন রেকর্ডও আছে। তখন গাউছিয়া মার্কেটের সামনের পুলিশ টাওয়ারে গিয়ে মাইকিং করে হারানো বিজ্ঞপ্তি দিতেও শুনেছি অনেকবার।
ওডিসির সামনে অনেক বছর ধরে শার্ট বিক্রি করেন আফজাল।
তিনি বলেন, 'ঈদের সময় আমাদের দৈনিক গড়ে ১৫ হাজার টাকার ব্যবসা হয়। দুই ঈদের ব্যবসা দিয়ে আমরা বাকি বছর পুষায়ে দিতে পারি।'

তবে ওডিসি-বাসীদের নিয়মিত এক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। তা হলো ঢাকা কলেজ আর সিটি কলেজের মারামারি। এই দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা বিচিত্র সব কারণে মারামারি করে কয়দিন পরপরই। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওডিসির সাধারণ দোকানি ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। অনেক সময় তারা নিজেরাও জড়িয়ে পড়ে মারামারিতে।
গত বছরে হয়ে যাওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ওডিসির ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল।
আফজাল বলেন, 'ঢাকা কলেজের ভাইদের দিকে যেদিন গুলি করতেছিল পুলিশ সাইন্সল্যাব মোড় থেকে, আমি দোকান বন্ধ করে ভাইদের সঙ্গে যোগ দিছিলাম। পুলিশের দিকে ইট (পিকেটিং) মারছি। গুলাগুলি আর ধরপাকড় শুরু হইলে দৌড় দিয়ে পালায়ে যাই। আমাদের পরিচিত এক ভাই ছিল, এদিকেই ফুটপাতে বসতো প্যান্ট নিয়ে। উনি গুলি লেগে মারা গেছিলেন সেদিন। তার কথা তো কেউ জানতে চায় না!'
ঢাকাবাসীর কাছে ওডিসি একটি ফ্যাশন কাল্টে রূপান্তর হচ্ছে দিনদিন। কম দামে ভালো মানের কাপড়-চোপড়ের জন্য মোটামুটি সব শ্রেণীর মানুষই এখানে এসে হাজির হয়। ওডিসির এই সংস্কৃতি টিকে থাকুক যুগ যুগ। এটাই ঢাকাবাসীর প্রত্যাশা।