মীরসরাইয়ে তৈরি করা হবে শিল্প বর্জ্য নিষ্কাশন সুবিধা, ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা

বছরের পর বছর বিলম্বের পর সরকার অবশেষে দেশের বিপজ্জনক শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংকট সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। ট্রিটমেন্ট, স্টোরেজ এবং ডিসপোজাল ফ্যাসিলিটি (টিএসডিএফ) প্রতিষ্ঠার জন্য জমি বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা) মীরসরাই ইকোনমিক জোনের ব্লক ২৪-এ একটি প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। সেখানে শিল্প বর্জ্য, বিশেষত শিপব্রেকিং শিল্পের বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি টিএসডিএফ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের শিপ রিসাইক্লিং উপ-বিভাগের যুগ্ম সচিব এবং টিএসডিএফ প্রকল্পের পরিচালক সুলতানা ইয়াসমিন ২৭ জানুয়ারি জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাইট পরিদর্শনের পর 'দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এই উদ্যোগটি ২০১৮ সালের বাংলাদেশ শিপ রিসাইক্লিং আইন অনুসারে সরকার প্রদত্ত এক নির্দেশনার আওতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে, যেখানে তিন বছরের মধ্যে একটি টিএসডিএফ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা ছিল। তবে, সাত বছর পরেও বারবার বিলম্বের কারণে নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি।
টিএসডিএফ একটি কেন্দ্রীভূত সুবিধা হিসেবে কাজ করবে, প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রামের শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডগুলোর জন্য এবং পরে অঞ্চলটির অন্যান্য শিল্প খাতের জন্য পরিবেশগতভাবে নিরাপদ ও দায়িত্বশীলভাবে বিপজ্জনক বর্জ্য নিষ্কাশন নিশ্চিত করবে।
প্রকল্প নতুন করে গতি পেয়েছে
প্রাথমিকভাবে ২০২২ সালের শেষে শিল্প মন্ত্রণালয় চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে টিএসডিএফ এর জন্য ২০ একর জমি চিহ্নিত করেছিল এবং জাইকা-র আর্থিক সহায়তায় একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করেছিল। তবে, সীতাকুন্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং ইকো পার্কের কাছাকাছি হওয়ার কারণে স্থানীয় বিরোধ এবং বন বিভাগের উদ্বেগের ফলে ২০২৪ সালে প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়।
পরে, কর্তৃপক্ষ মীরসরাই ইকোনমিক জোনে একটি নতুন স্থান নির্বাচন করে। তবে ২৭ জানুয়ারি জাইকা প্রতিনিধিদল এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাইট পরিদর্শনের ফলে প্রকল্পটি নিয়ে নতুন আশা তৈরি হয়েছে।
সুলতানা ইয়াসমিন বলেন, "আমরা জাইকার বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে সাইটটি পরিদর্শন করেছি। তারা স্থানের বিষয়ে সন্তুষ্ট। এখন তারা একটি নতুন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালাবে, যা প্রয়োজনীয় তহবিল এবং নির্মাণ সময়সীমা স্পষ্ট করবে।"
জাইকার বিশেষজ্ঞ ওকোমোতো আকিরা নিশ্চিত করেছেন, এই সমীক্ষা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে শুরু হবে এবং এটি প্রায় এক বছর সময় নেবে। তিনি বলেন, "ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) অনুমোদিত হলে নির্মাণে দুই বছর সময় লাগবে। যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে, তাহলে টিএসডিএফ ২০২৮ সালের শেষ অথবা ২০২৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে কার্যক্রম শুরু করবে।"
পরিবেশগত ও শিল্পগত জরুরি প্রয়োজনীয়তা
টিএসডিএফ এমন একটি সুবিধা, যা বিপজ্জনক বর্জ্য পরিচালনা করার জন্য তিনটি মূল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করে: ট্রিটমেন্ট, যেখানে বর্জ্যের গঠন পরিবর্তন করে তা কম বিপজ্জনক করা হয় অথবা পুনঃব্যবহারযোগ্য করা হয়; স্টোরেজ বা সংরক্ষণ, যেখানে বর্জ্য ট্রিটমেন্ট বা নিষ্কাশন করার আগ পর্যন্ত সাময়িকভাবে নিরাপদ কনটেইনারে রাখা হয়; এবং নিষ্কাশন, যেখানে পরিবেশ দূষণ রোধ করতে বর্জ্যটি সাধারণত একটি বিশেষভাবে নির্মিত ল্যান্ডফিলে স্থায়ীভাবে ধারণ করা হয়।
এই সুবিধাগুলো নিশ্চিত করে, বিপজ্জনক বর্জ্য নিরাপদ ও দায়িত্বশীলভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে একটি সম্পূর্ণ কার্যকর টিএসডিএফ না থাকার কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। শিল্পখাত, বিশেষ করে চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো বিপজ্জনক বর্জ্য সরাসরি পরিবেশে ফেলছে।
২০১৬ সালের একটি ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) এর গবেষণায় বলা হয়, শুধু শিপব্রেকিং শিল্পই বছরে পুড়িয়ে ফেলা যায় এমন ৫ হাজার ৯০০ টন বর্জ্য এবং ৮ হাজার ৯০০ টন ল্যান্ডফিলযোগ্য বর্জ্য উৎপাদিত হয়। চট্টগ্রামের অন্যান্য শিল্পখাত বছরে বিপজ্জনক ৬৮ হাজার ৬০০ টন বিষাক্ত বর্জ্য তৈরি করে।
২০১০ সালের একটি বিশ্বব্যাংক গবেষণায় সতর্ক করা হয়, যদি টিএসডিএফ প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে সীতাকুণ্ডের উপকূলীয় এলাকায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৭৯ হাজার টন অ্যাসবেসটস, ২ লাখ ৪০ হাজার টন পিসিবি, ১৯ লাখ ৭৮ হাজার টন জৈব তরল বর্জ্য, ৭৭৫ টন অজৈব বর্জ্য এবং ২ লাখ ১০ হাজার টন ওজোন-বিনাশী পদার্থ জমে যেতে পারে।
টিএসডিএফ বিপজ্জনক বর্জ্য, যেমন শিল্প বর্জ্য, চিকিৎসা বর্জ্য এবং ই-ওয়েস্ট ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয়। এসব বর্জ্যের ক্ষয়কারী, প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী এবং বিষাক্ত প্রকৃতির কারণে পরিবেশের ক্ষতি রোধ করতে বিশেষ ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন।
টিএসডিএফ-এর জরুরি প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী শিপব্রেকিং খাতে শীর্ষস্থানীয়, গত দুই দশকে বিশ্বের ৪০–৫০ শতাংশ নিষ্ক্রিয় নৌযান দেশে ভাঙা হয়েছে। তবে, একটি বিশেষায়িত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুবিধার অভাবে আন্তর্জাতিক পরিবেশগত মান পূরণে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি জহিরুল ইসলাম রিংকু টিএসডিএফ নির্মাণের জরুরি প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, "হংকং আন্তর্জাতিক চুক্তি (এইচকেসি) অনুযায়ী, জাহাজ থেকে বিপজ্জনক বর্জ্য নিরাপদভাবে টিএসডিএফ-এ নিষ্কাশন করতে হবে। আমরা এমন একটি সুবিধার অভাবে বিপজ্জনক বর্জ্য বর্তমানে শিপইয়ার্ডে সাময়িকভাবে সংরক্ষণ করছি। তবে জায়গা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।"
রিংকু সতর্ক করে বলেন, "এক বা দুই বছরের মধ্যে এই সংরক্ষণ ক্ষেত্রগুলোর ধারণ ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে। ফলে এইচকেসি অনুযায়ী কাজ করা আরও কঠিন হবে।"
তিনি সরকারের কাছে টিএসডিএফ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানান, যাতে শিল্পখাতের পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায় এবং বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতে সমস্যা না হয়।
জাইকা থেকে নতুন সমর্থন পাওয়ায় প্রকল্পটির সামনে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী।