যে কারণে বিজিএমই-এর গার্মেন্টস পার্কসহ ১০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের লাইসেন্স বাতিল হলো

পরিবেশগত ছাড়পত্র না পাওয়া, উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহ, ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল না করায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) দেশের পাঁচটি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি—মোট ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের লাইসেন্স বাতিল করেছে।
গত ১৩ অক্টোবর বেজার গভর্নিং বোর্ডের অষ্টম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বোর্ডের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বিষয়টি নিয়ে গত ১৩ এপ্রিল রাজধানীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানান, 'আমরা মনে করি এই ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রয়োজন নেই। তাই এসব লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।'
বাতিল হওয়া পাঁচটি সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল হলো—কক্সবাজারের সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক, বাগেরহাটের সুন্দরবন ট্যুরিজম, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া ইকোনমিক জোন, গাজীপুরের শ্রীপুর ইকোনমিক জোন এবং ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ময়মনসিংহ ইকোনমিক জোন।
বেসরকারি পাঁচটি অঞ্চল হলো—বিজিএমইএ'র প্রস্তাবিত গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ পার্ক (মুন্সিগঞ্জ), সুনামগঞ্জের ছাতক ইকোনমিক জোন, বাগেরহাটের ফ্যামকাম ইকোনমিক জোন, ঢাকার সিটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ইকোনমিক জোন।
গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ পার্ক কেন বাতিল
মুন্সিগঞ্জের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ পার্ক স্থাপনের জন্য ৪৭০ একর জমি বরাদ্দ করা হলেও, ২০১৩ সালের পর আজও সেখানে কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি। বেজা সূত্র জানায়, আবেদনকারী সংগঠন (বিজিএমইএ) মৌখিকভাবে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করেনি।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান টিবিএসকে বলেন, জমি নিয়ে জটিলতা ছিল, দামও ছিল বেশি। তাছাড়া একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে সমস্যাও ছিল। এসব বিবেচনায় কেউ বিনিয়োগ করতে চাননি।
তিনি আরও বলেন, এরপর যখন চট্টগ্রাামের মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল শুরু হয় সেখানে বিজিএমইএ'র সদস্যদের জন্য জমি বরাদ্ধ দেওয়া হয়। এছাড়া আমাদের অনেক উদ্যোক্তা সদস্য ব্যক্তিগতভাবে জমি বরাদ্ধ নেন। মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার পর মুন্সীগঞ্জের তৈরিপোশাক শিল্পপল্লী হওয়া না হওয়ায় কোনো পার্থক্য নেই তৈরি পোশাকখাতের উদ্যোক্তাদের কাছে।
উল্লেখ্য, মীরসরাইয়ে ৫০০ একর জমিতে বিজিএমইএর গার্মেন্টস ভিলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বেজার সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে।
পরিবেশ ও আইনি জটিলতায় বাতিল সোনাদিয়া ও সোনারগাঁও
কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়ায় ৯,৪৬৭ একর জমি বন বিভাগের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে বেজা। পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বেজা চেয়ারম্যান জানান, 'সোনাদিয়া দ্বীপ পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই জমি বন বিভাগকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।'
এদিকে, সোনারগাঁও ইকোনমিক জোন লিমিটেড (ইউনিক গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান) ২০১৬ সালে প্রাক-যোগ্যতা লাইসেন্স পেলেও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে এর লাইসেন্স বাতিল করে বেজা।
সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্কের ক্ষেত্রেও বেজা কোনো পরিকল্পনা না থাকায় কক্সবাজারের মহেশখালীর ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমি বন বিভাগের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। বেজা'র নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, 'শিল্পায়ন চাই, তবে পরিবেশ ধ্বংস করে নয়। পরিবেশবান্ধব পাঁচটি ইকোনমিক জোনই দেশের চেহারা বদলে দিতে যথেষ্ট।'
তিনি আরও জানান, মীরসরাইয়ে ১৬ হাজার একর জমি ইতোমধ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে অলস পড়ে থাকা জমিতে ৩০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
জমির সংকট ও খরচে বাতিল আরও কয়েকটি অঞ্চল
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ৯৭ দশমিক ৯৮ একর খাস জমির মধ্যে ৪৬ দশমিক ২১ একর নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় এবং বাকি জমি নিয়ে জটিলতা থাকায় গজারিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে।
শ্রীপুরের মাওনা ও ধনুয়া মৌজার ৫১০ একর জমিতে জোন গঠনের পরিকল্পনা থাকলেও পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জে জাপানীজ ইকোনমিক জোন হওয়ার পর শ্রীপুর জোনের প্রয়োজনীয়তা আর থাকেনি।
ময়মনসিংহ সদরে প্রস্তাবিত ৪৬৮ একরের মধ্যে ৩২০ দশমিক ৭৭ একর ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন। অধিগ্রহণ ব্যয় বেশি হওয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়নি।
এছাড়া ফ্যামক্যাম, চাতাক এবং সিটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন—এই তিনটি বেসরকারি জোন বাতিলের বিষয়ে বেজা জানায়, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর আগ্রহী নয়।
'১০০টা নয়, ৫টি ভালো ইকোনমিক জোনই যথেষ্ট'
চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক বলেন, 'আমাদের দেশে বিশাল বিশাল ১০০ ইকোনমিক জোনের দরকার নেই। ঠিকভাবে ৫টি পরিবেশবান্ধব জোন করলেই দেশের চেহারা পাল্টে যাবে।'
তিনি জানান, মীরসরাইয়ে আগে যে বনাঞ্চল ছিল তা বাদ দিয়ে এখন ১৬ হাজার একর জমি আছে। এতেই আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। এছাড়া মাতারবাড়িতেও কয়েক হাজার একর জমি রয়েছে।
অব্যবহৃত জমিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি। বলেন, 'আমরা চাই শিল্পায়ন হোক, তবে পরিবেশ ধ্বংস করে নয়। আগামী প্রজন্মকে একটি সবুজ দেশ দিয়ে যেতে চাই।'
তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদনের আগে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে সব মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে পরিষেবা দেওয়ার নিশ্চয়তা নিতে হবে। কেননা, অনুমোদন পেলেও অনেক সময় বিনিয়োগকারীরা সেবা পান না।