বিনিয়োগ সংস্থাগুলোর একীভূতকরণ পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন করবে বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ প্রচার সংস্থাকে একীভূত করে একটি একক, ঐক্যবদ্ধ সত্তা গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) এবং হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ—এই চারটি সংস্থাকে একীভূত করার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আরও সমন্বিত ও কার্যকরভাবে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর আইনি কাঠামো প্রণয়নের দায়িত্ব পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হবে।
২১ মে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুযায়ী, 'ডিএফডিএল' নামক একটি আন্তর্জাতিক আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে এ সংক্রান্ত একটি 'সুপার অ্যাক্ট' খসড়া তৈরির জন্য নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের আওতায় বিদ্যমান পৃথক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে একটি একক ও ঐক্যবদ্ধ পরিচালনা পর্ষদ গঠনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বিডা ও বেজার কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, এই পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং এতে বিশ্বব্যাংক আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। শর্তাবলি প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে এবং কর্মকর্তারা আশা করছেন, ঈদের ছুটির পরপরই নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।
বৈঠকে উপস্থিত বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এ উদ্যোগকে একটি কৌশলগত একত্রীকরণ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই একীভূতকরণের মূল উদ্দেশ্য হলো বিনিয়োগ প্রচারের দক্ষতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা এবং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশকে আরও বিনিয়োগবান্ধব গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলা।
তিনি আরও তুলে ধরেন, বর্তমানে প্রচলিত কিছু নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অসঙ্গতি বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) ৯৯ বছরের জন্য জমি লিজ দিলেও বিডা ও বেজা লিজ দেয় ৪০ বছরের জন্য। আবার, প্রতিটি সংস্থা নিজস্বভাবে 'ওয়ান-স্টপ সার্ভিস' পরিচালনা করে, কিন্তু এসব সেবার মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এছাড়া, সংস্থাগুলোর গভর্নিং বডিতে সদস্যদের ঘন ঘন ওভারল্যাপ এবং অল্প সংখ্যক বৈঠকের কারণে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। এসব জটিলতা নিরসনে তিনি প্রস্তাব করেন, একীভূত নতুন সংস্থার জন্য নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যান পদ সৃজন করা উচিত।
বৈঠকে উপস্থিত প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী পরামর্শ দেন, বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্ট কর্মীদের তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিডা ও বেজার গভর্নিং বোর্ডগুলোর একীভূতকরণকে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
অর্থ সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার শুধু বিডা, বেজা, বেপজা ও হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ নয়, বরং বিসিক ও সরকারি ক্রয় কর্তৃপক্ষকেও (পিপিএ) একীভূতকরণ পরিকল্পনার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত দেন। তার মতে, তিন বা চারটি পৃথক বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থার মধ্যে বাস্তবিক সমন্বয় সাধন প্রায় অসম্ভব। সেই সঙ্গে তিনি জোর দেন, একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মীদের জ্যেষ্ঠতাবিষয়ক বিষয়গুলো সংবেদনশীলভাবে বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বৈঠকে বিসিকের ব্যর্থ ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তিনি বলেন, সাভারের চামড়া শিল্প এলাকায় বিসিক কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি, ফলে চামড়া শিল্প পার্কটিকে বিসিকের আওতা থেকে বাদ দেওয়া উচিত।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেছুর রহমান মন্তব্য করেছেন, চামড়া রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। কিন্তু সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত না হওয়ায় উদ্যোক্তারা চীনা ক্রেতাদের কাছে চামড়া এক-তৃতীয়াংশ দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে, উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কমিটির প্রধান এবং শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থাগুলোর একীভূতকরণ নিয়ে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, 'দেশের বিদ্যমান বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে একীভূত করার ক্ষেত্রে কোনও তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়।'
কমিটির প্রারম্ভিক বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বাণিজ্য উপদেষ্টা এসকে বশির উদ্দিন জানান, একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য জটিলতা মোকাবিলায় অ্যাটর্নি জেনারেলকে ভবিষ্যতে এ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে, কারণ পুরো প্রক্রিয়াটি নানা ধরনের আইনি জটিলতার সঙ্গে জড়িত।
এই প্রক্রিয়ার জন্য সরকারের নির্ধারণ করা আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা সংস্থা একীভূত সংস্থার কাঠামো ও প্রশাসনিক পরিচালনার ছক তৈরি করবে। একইসঙ্গে, সংযুক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে কর্মীদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের বিষয়ে প্রাথমিক সুপারিশও উক্ত প্রতিষ্ঠান প্রদান করবে।
কমিটির কার্যবিবরণী অনুসারে, সদস্যরা একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সময় বিনিয়োগ কার্যক্রমে যেন কোনও বিঘ্ন না ঘটে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অধিকার ও পদমর্যাদা যাতে অক্ষুণ্ন থাকে, সে বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেছেন।
তবে সরকারি পর্যায় থেকে জোরালো সমর্থন থাকলেও, বেপজা এই একীভূতকরণ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বলে জানা গেছে। বিডার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'প্রতিটি বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থা একটি পৃথক আইনের আওতায় গঠিত। এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের আইন অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত। এই প্রেক্ষাপটে, এগুলো একীভূত করা অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়াবে।'
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'এর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বিভাজনের সময় সরকার যে ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি এড়াতেই একজন অভিজ্ঞ বিদেশি পরামর্শদাতা নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
অন্যদিকে, ব্যবসায়ী নেতারা সরকারের এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ফিকি)-এর নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবির বলেন, সংস্থাগুলোর একীভূতকরণ ব্যবসায়িক পরিবেশে উল্লেখযোগ্য সুফল আনবে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বর্তমানে একাধিক সংস্থা প্রায় একই ধরনের কাজ করছে, যা ব্যবসা ও বিনিয়োগ প্রচারে একধরনের জটিলতা সৃষ্টি করছে। বিনিয়োগকারীদের প্রায়শই এক ধরনের সেবা পেতে একাধিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়।' তিনি আরও বলেন, 'যদি এসব সংস্থাকে একীভূত করে একটি একক ব্যবসা ও বিনিয়োগ-কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা যায়, তাহলে তা বিনিয়োগকারীদের জন্য অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক হবে। পাশাপাশি, সরকারের বিনিয়োগ ও ব্যবসা উন্নয়ন কার্যক্রমও হবে আরও সুসংগঠিত ও কার্যকর।'