মিয়ানমারে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন; জনমনে আতঙ্ক বাড়ছে

মিয়ানমারের জনসাধারণের নিরাপত্তা বিষয়ে কাটছে না আতঙ্কের রেশ। অতি সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অঞ্চল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং 'প্রতিপক্ষ'কে কাবু করতে তারা তথ্য সম্প্রচারের সকল উপায় বন্ধ করে রেখেছে।
১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর সেনাবাহিনীর নৃশংসতার পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশজুড়ে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ, নির্যাতন ও আটক করে নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বুধবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট সিএনএনের প্রতিনিধি বেকি অ্যান্ডারসনকে জানিয়েছেন, এখনো পর্যন্ত মিয়ানমারের পুলিশ বা সেনাবাহিনীর হাতে ২০০ জন আন্দোলনকারী মারা গেছেন।
ব্যাচেলেট আরও জানান, মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে। কারণ কিছু এলাকায় যাওয়ার অনুমতি ইউএন এজেন্সি পায়নি, যেখানে আরও বেশি লোককে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
ব্যাচেলেট জানান, এখন পর্যন্ত ২৪০০ জনকে বন্দী করে রেখেছে সেনাবাহিনী।
এই সপ্তাহে মিয়ানমারে চীনাভিত্তিক ফ্যাক্টরিগুলোতে অজ্ঞাতনামা কিছু লোক অগ্নিসংযোগ করে। এই ঘটনা চলমান অবস্থায়ই অভ্যুত্থানবিরোধীদের ওপর সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন হামলার পরদিন জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের বাহিনী ইয়াঙ্গুনের ছয়টি অঞ্চলে মার্শাল ল জারি করে। দ্বিতীয় শহর মান্ডালেতেও মার্শাল ল জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউএন হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস।
ইন্টারনেট মনিটরিং সার্ভিস নেটব্লকস সূত্রে জানা যায়, বুধবার পুরো মিয়ানমারে এক মুহূর্তেই মোবাইল নেটওয়ার্ক ডেটা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্য থেকে খুব কম তথ্যই বাইরে আসতে পারছে। তাই মিয়ানমারের সত্যিকার পরিস্থিতি বোঝা ও যাচাই করা বিভিন্ন সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরাসরি প্রতিবাদ মিছিলগুলো দেখাতে এবং পুলিশি নির্যাতনের ভিডিও রাখতে আন্দোলনকারী ও সাংবাদিকরা এখন নিজেদের মোবাইল ফোনের ওপর নির্ভর করছেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর দমন-নিপীড়ন যে পর্যায়ে চলে গিয়েছে, তাতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অবাধ হত্যা-গ্রেপ্তার চালাতে পারে সেনাবাহিনী।
ইয়াঙ্গুনে অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনে ব্রিজের ওপর বানানো অস্থায়ী ব্যারিকেডে আগুন ধরিয়ে দেয় পুলিশ।
মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটসের সিনিয়র হিউম্যান রাইটস স্পেশালিস্ট জন কুইনলি বলেন, 'ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় সিলগালা করে দেওয়া এলাকাগুলোতে মানুষেরা কী অবস্থায় আছেন, তা বাইরের কেউ জানতেই পারছে না। সামরিক জান্তা তাদের নৃশংসতার কথা গোপন করার জন্য সব রকম চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা একটি টোটাল ব্ল্যাকআউট তৈরি করতে চাচ্ছে।'
বুধবার মধ্যরাতের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন স্থানে গুলিবর্ষণ করেছে বলে রিপোর্টে জানা যায়। এছাড়াও সেসব এলাকার বাসিন্দাদের দেওয়া ব্যারিকেডও তারা সরিয়ে দিয়েছে।
ইয়াঙ্গুনে বুধবার সেনাবাহিনীর এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণে ২৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, একজন স্থানীয় সাংবাদিক এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। ঘটনাটি ঘটে মিঙ্গালার টং নিয়্যুন্ট টাউনশিপে রাতের বেলা আন্দোলনে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যেই সেনাবাহিনী এই হামলা চালায় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
মানবাধিকার কর্মীরা বিশেষভাবে ইয়াঙ্গুনের হ্লাইংথায়া নামক একটি ছোট শিল্প শহরের কথা জানিয়েছেন। এখানে বহু প্রবাসী শ্রমিক ও ফ্যাক্টরি শ্রমিক কাজ করেন এবং এটি আন্দোলনের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র। এখানে রোববার সেনাবাহিনীর গুলিতে ৭৪ জন এবং সোমবার আরও ২০ জন মারা যান এবং ফ্যাক্টরিগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার মার্শাল ল জারির পর হাজার হাজার মানুষ হ্লাইংথায়া থেকে পালিয়ে গেছে বলে রয়টার্স ও মিয়ানমারের স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে। হ্লাইংথায়ার এক শ্রমিকের ভাষ্যে, জায়গাটি এখন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো; সেনাবাহিনী সব জায়গায় গুলি চালাচ্ছে।
দুজন চিকিৎসক এ-ও জানিয়েছেন, এখানকার আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার প্রয়োজন; কিন্তু সেনাবাহিনী প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ইয়াঙ্গুনে মার্শাল ল জারিকৃত এলাকাগুলোতে এখন যে কেউ গ্রেপ্তার হলেই তাকে সামরিক আদালতে সাজা দেওয়া যাবে। এই সাজার মধ্যে রয়েছে আজীবন কারাদণ্ড, কঠোর শ্রম এবং মৃত্যুদণ্ড।
মিলিটারি জান্তার অধীনে মার্শাল ল জারির মানে হচ্ছে ওই অঞ্চলগুলোতে এখন পূর্ণ প্রশাসনিক ও আইনি ক্ষমতা মিলিটারি কমান্ডারের হাতে। মিয়ানমারের স্থানীয় গণমাধ্যম আউটলেট এ তথ্য জানিয়েছে।
অতীতেও মিয়ানমারে এ ধরনের সাজা দেওয়ার নজির রয়েছে। তখন এই কাজগুলো হতো লোকচক্ষুর আড়ালে এবং এক্ষেত্রে দণ্ডাদেশ এক রকম অবধারিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া ডিভিশনের আইনি পরামর্শক লিন্ডা লাখধির জানান, এই আইনের ফলে যাদের গ্রেপ্তার করা হবে, সেসব নিরপরাধ ব্যক্তি ন্যায্য বিচার, এমনকি আপিল করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবেন।
এদিকে জেনারেল মিন অং হ্লাইং মঙ্গলবার গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারকে বলেছেন, 'আন্দোলন যখন দাঙ্গা ও সহিংসতায় পরিণত হয়েছে, তখনই আমরা মার্শাল ল জারি করেছি।'
মিয়ানমার পুলিশের দাবি, আন্দোলনকারীরা সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছেন। তারা ফ্যাক্টরি পুড়িয়েছেন এবং পুলিশ স্টেশন ও সরকারি ভবনে হামলা চালিয়েছেন। তাই পুলিশ এ পরিস্থিতি কঠোরভাবে দমন করতে বাধ্য হয়েছে।
তবে মিয়ানমারে সামরিক জান্তা বিরোধী কর্মকাণ্ড এখনো ছড়িয়ে পড়ছে। বৌদ্ধ ধর্মপ্রধান এই জাতির সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সংগঠন বুধবার সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে সেনা অভ্যুত্থান এবং জনসাধারণের আইন-অমান্য আন্দোলনের ফলে মিয়ানমারের অর্থনীতি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইউএন ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম এর তথ্যানুযায়ী, দেশটিতে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম ইতিমধ্যেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
- সূত্র: সিএনএন