রেমিট্যান্সে ভর করে দীর্ঘদিন পর দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত

ঊর্ধ্বমুখী রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর ভর করে দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) অন্যতম উপাদান কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স বা চলতি হিসাব দীর্ঘদিন পর ইতিবাচক (পজিটিভ) ধারায় ফিরে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট শেষে দেশের চলতি হিসাবে ব্যালেন্স ১১১ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে— যেখানে গেল অর্থবছরের একই সময়ে চলতি হিসাবে ব্যালেন্স ঘাটতি ছিল ৬১০ মিলিয়ন ডলার।
এর আগে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে শেষবারের মতো চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ব্যালেন্স রেকর্ড হয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মূলত রেমিট্যান্সে জুলাই-অগাস্ট সময়ে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটাই চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত হওয়ার মূল কারণ। সেপ্টেম্বরেও এই ধরা বজায় আছে।"
তিনি বলেন, "মূলত আমাদের দেশে আসা রেমিট্যান্স ইনফরমাল চ্যানেল থেকে ফরমাল চ্যানেলে ডাইভার্ট হওয়ায় এই প্রবৃদ্ধি এসেছে। এর একটা কারণ হতে পারে, দেশ থেকে টাকা পাচার হওয়া অনেকটাই কমে এসেছে।"
টাকা পাচার কেন কমেছে জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, "যারা অর্থ পাচারকারী ছিল, অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই পাচার হয়ে গেছে অথবা আত্মগোপনে চলে গিয়েছে। ফলে টাকা পাচার কমেছে। তবে, নতুন কোনো পাচারকারী গ্রুপ যেন এই জায়গাটি নিতে না পারে সেজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দেশের বাণিজ্য ঘাটতিও কমে এসেছে। অর্থাৎ, দেশের রপ্তানি ও আমদানির পার্থক্য কমে এসেছে। ২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট শেষে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২.৭৫ বিলিয়ন ডলারে— যা গত অর্থবছরে ছিল ৩.০৪ বিলিয়ন ডলার।
অর্থবছরের প্রথম দুইমাসে দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.৫ শতাংশ এবং আমদানি ১.২ শতাংশ কমেছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, "ট্রেড ডেফিসিট (বাণিজ্য ঘাটতি) কমেছে, এটা আমাদের জন্য ভালো। বিশেষ করে, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির মধ্যে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, অথচ এটি কমার সম্ভাবনা ছিল।"
"তবে আমদানি কমছে, এটি আমাদের মতো অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। কারণ আমদানি কমে যাওয়ার মানে হলো বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমে যাওয়া। এগুলো চালু থাকলে আমদানিতে প্রবৃদ্ধিটা ভালো হতো। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি যে কমেছে, এটা ভালো এবং খারাপ খবরের মিশ্রণ," যোগ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই-অগাস্ট শেষে দেশের ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট বা ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৪৫ মিলিয়ন ডলার। ২০২৪ অর্থবছরের একই সময় শেষে এই ঘাটতি ছিল ১.৩২ বিলিয়ন ডলার।
জাহিদ হোসেন বলেন, "আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হলেও জুলাই-অগাস্টে ৪৭৪ মিলিয়ন ডলার নিট ট্রেড ক্রেডিট ডেফিসিট তৈরি হয়েছে; অর্থাৎ এই পরিমাণ রপ্তানি আয় আমাদের দেশে আসেনি। ট্রেড ফাইনান্সিংয়ের ক্ষেত্রেও বিদেশি ব্যাংকগুলোতে আমাদের দেশ নিয়ে আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছিল, সেটিও খুব একটা কমেনি। অর্থাৎ, বাস্তবতা খুব বেশি বদলায়নি।"
"এ কারণেই ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে আমরা এখনো ঘাটতিতেই আছি," যোগ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, দেশের ২০৫ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১.৪ বিলিয়ন ডলার— যা গত বছরে ছিল ১.৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২৫ অর্থবরে ঘাটতি হওয়ার পেছনে মূল কারণ 'এরোর অ্যান্ড অমিশন' এর নেগেটিভ ব্যালেন্স ১.৪৩ বিলিয়ন ডলার— যেটি ২০২৪ অর্থবছরের একই সময় শেষে ছিল পজিটিভ ২৪১ মিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, "এরোর অ্যান্ড অমিশন এর নেগেটিভ ব্যালেন্স এর অর্থ হলো অনরেকর্ডেড আউটফ্লো; অর্থাৎ, রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ হয়ে গেছে, তবে তার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।"
জাহিদ হোসেনের মতে, "২০২২ সাল থেকে দেশের বিওপি-তে যে চাপ তৈরি হয়েছে, সেটি এখনো কমেনি। সামগ্রিক ব্যালেন্স নেগেটিভ হওয়ার মানে হলো, এই ডলার দেশের রিজার্ভ বা ফিন্যান্সিয়াল খাত থেকে পরিশোধ করতে হয়েছে। এরোর অ্যান্ড অমিশনের নেগেটিভ ব্যালেন্স থাকলে সেখানে টাকা পাচারের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে এটি পরিষ্কার বলা কঠিন।"
ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ভালো অবস্থানে যেতে ফরমাল ও ইনফরমাল চ্যানেলের ডলারের দামের পার্থক্য বাড়তে দেওয়া যাবে না মন্তব্য করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, "ডলারের দাম নয়মনীয় থাকা উচিৎ। অনেক মাল্টিলেটরল অর্গানাইজেশন থেকে আমরা ডলার সাপোর্ট পাচ্ছি। এছাড়া, গত কিছুদিন ধরে ডলারের দামে একটা স্থিতিশীলতা এসেছে। তাই, আমাদের জন্য বাজার-ভিত্তিক ডলার রেটে যাওয়ার এখনই সুযোগ।"
আমদানি বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, "একটি অর্থনীতিতে ব্যাঘাত ঘটলে সবার মধ্যেই আতঙ্ক কাজ করে। দেশের আর্থিক খাতের অনেক জায়গাতেই আন্দোলনসহ নানান সমস্যা হচ্ছে। দেশে আইন শৃঙ্খলার এ যে সমস্যা চলছে, সেটি ঠিক হয়ে গেলে বিনিয়োগ বাড়বে।"
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ এর রেট কাট করার উপর আমাদের দেশের বিওপি প্রভাবিত হয়। গত সেপ্টেম্বরে ফেডারেল রিজার্ভ একবার রেট কাট করেছে (কমিয়েছে)। ভবিষ্যতে রেট কাট করা হলে, দেশের বিওপি'র উপর চাপ আরো কমে আসবে।