নওগাঁর আম রপ্তানি বদলে দিতে পারে উত্তরের কৃষি অর্থনীতির চিত্র

নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় এবার গড়ে এক কেজি আম্রপালি জাতের আম বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা কেজি দরে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে এই আমের দাম প্রতি কেজি ৫০০ টাকার ওপরে। এই আম রপ্তানি করতে পারলে লাখ লাখ কৃষকের ভাগ্য বদলের সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতেও।
সম্প্রতি কাতারে আম উৎসব থেকে ফিরে সাপাহারের বরেন্দ্র এগ্রো পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল রানা এমনটাই জানিয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে কৃষি উদ্যোক্তা হয়েছেন সোহেল রানা। তিনি জানান, গত ২৫ জুন থেকে ১ জুলাই কাতারের রাজধানী দোহার সুক ওয়াকিফে বাংলাদেশি ম্যাংগো ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনে এ উৎসবে তিনি সাড়ে চার টন আম নিয়ে গিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে প্রতি কেজি আমে তার খরচ হয়েছে ২৫০ টাকা। বিক্রি করেছেন ৫০০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ, তিনি প্রায় ২৭ লাখ টাকার আম বিক্রি করেছেন। দেশের বাজারে যার দাম সর্বোচ্চ চার লাখ টাকা।
সোহেল জানান, উৎসব ছিল সাত দিনের। কিন্তু চার দিনেই তার সব আম বিক্রি হয়ে যায়। রপ্তানিতে কৃষকরা ব্যাপক লাভবান হতে পারে উল্লেখ করে এই উদ্যোক্তা বলেন, আমাদের দেশীয় আমের স্বাদের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
সোহেল বর্তমানে প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে আম চাষ করছেন। ২০২১ সাল থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছোট পরিসরে আম রপ্তানিও করছেন তিনি।
তবে আম রপ্তানিতে কিছু সংকটের কথা জানান সোহেল। এসবের মধ্যে রয়েছে- উত্তম কৃষি চর্চা (গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস বা গ্যাপ) অনুসরণ না করা, অতিরিক্ত উড়োজাহাজ ভাড়া, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের (চুক্তিতে চাষাবাদ) ভিত্তিতে আম চাষ না হওয়া (কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে রপ্তানিকারক ও আমচাষি পর্যায়ে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং হয়), আম উৎপাদনকারী অঞ্চলে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট (ভিএইচটি) প্ল্যান্ট না থাকা।
সাপাহারের অধ্যাপক মোকলেছুর রহমান ২০ বিঘা জমিতে আম চাষ করেছেন। তিনিও আম রপ্তানির বিষয়ে সোহেলের মতোই সংকটের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি জানান, দেশে সরকারি পর্যায়ে ঢাকার শ্যামপুরে একমাত্র ভ্যাপার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে। এর মাধ্যমে আম দূষণমুক্ত করা হয়। এছাড়া আম বাছাইয়ের জন্য প্যাকিং হাউস ও কোয়ারেন্টিন সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রেও ভোগান্তি রয়েছে। এগুলোর সমাধান হলে এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির বিপ্লব ঘটবে।

কৃষি কর্মকর্তা ও আম চাষিরা বলছেন, দেশের একমাত্র ভ্যাপার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে বছরে মাত্র পাঁচ হাজার টন আম দূষণমুক্ত করে প্যাকেজিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে সরকারের। কিন্তু দেশে বছরে কয়েক লাখ টন রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হচ্ছে। এগুলো দেশীয় বাজারে অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
কৃষি দপ্তরের তথ্যমতে, আম উৎপাদনে রাজশাহী বিভাগের মধ্যে মৌসুমে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নওগাঁ। গত বছরের তুলনায় ৩০০ হেক্টর জমি বেড়ে এ বছর জেলায় আম চাষ হয়েছে ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টরে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন। এর বাজারমূল্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। নওগাঁয় উৎপাদিত আমের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই আম্রপালি জাতের। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে বারি-৪ জাতের আম। এর চাহিদাও ব্যাপক। এছাড়াও জেলায় ল্যাংড়া, গৌড়মতি, আশ্বিনা, হিমসাগর, গোপালভোগ ও কাটিমন জাতের আম চাষ হয়।
গ্যাপ মেনে চাষাবাদ করলে সবগুলো জাতই প্রায় রপ্তানিযোগ্য বলে জানান চাষিরা। গ্যাপ হলো নিরাপদ ফসলের নিশ্চয়তা। উন্নত বিশ্বে বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।
সাপাহারের আমচাষি সোহানুর রহমান সবুজ বলেন, রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে সরকার চাষিদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে আম রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। তাহলে সরকার ও চাষি দুই পক্ষই লাভবান হবে।
আম রপ্তানিতে সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উত্তম কৃষি চর্চা প্রয়োগ করে রপ্তানিযোগ্য উৎপাদন প্রকল্পের মাধ্যমে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে চীন, যুক্তরাজ্য, কাতার, ইতালিসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে নওগাঁর প্রায় ২৫০ টন আম রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানি সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়েও কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে।

তবে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা আম এখনো মধ্যপ্রাচ্যের মূলধারার বাজার ধরতে পারেনি বলে জানান বৈশ্বিক উত্তম কৃষি চর্চার (গ্যাপ) নিবন্ধিত প্রশিক্ষক ও শের-ই বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ।
তিনি বলেন, আমাদের দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া আমের বেশিরভাগই সেখানকার বাঙালি কমিউনিটির কাছে বিক্রি হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে কয়েক বছরের মধ্যে ২০২১-২২ সালে সর্বোচ্চ তিন হাজার ১০০ টন আম রপ্তানি করা হয়। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত রপ্তানি করা হয়েছে মাত্র দুই হাজার টন। অথচ দেশে বছরে প্রায় ২৭ লাখ টন আম উৎপাদন হয়।
অধ্যাপক ফারুক আহম্মেদ বলেন, গ্যাপ মেনে আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে অডিট, অনুশীলন, রাসায়নিক ওষুধ বা সার প্রয়োগ, মাটি পরীক্ষা, সার-পানি দেওয়ার রেকর্ড রাখা, আমের মধ্যকার বিষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সনদ নবায়নসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। এগুলো নিয়ম মেনে করলে আম রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। আবার আমের বাই প্রডাক্ট তৈরি করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের সুযোগ রয়েছে।

সাপাহারে 'দেশের বড়' আম বাজার
নওগাঁর সাপাহার উপজেলার জিরো পয়েন্ট থেকে চারটি রাস্তা চারদিকে চলে গেছে। এর মধ্যে একটি পত্নীতলা উপজেলার নজিপুরের দিকে, আরেকটি পোরশা উপজেলার দিকে, উপজেলা চত্বর হয়ে খঞ্জনপুর গেছে; একটি আরেকটি রাস্তা তিল্লা সড়ক নামে পরিচিত।
মে, জুন ও জুলাই- এই তিন মাসে সাপাহার জিরো পয়েন্ট থেকে চারদিকের এই সড়কে প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটারজুড়ে আমের হাট বসে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। এ সময়টায় যানজটে ভোগান্তিতে পড়েন এ পথের যাত্রীরা। সড়কের ওপর আম বিক্রি করলেও নেওয়া হয় ইজারা। এছাড়া আঞ্চলিক এ মহাসড়কের ওপর ফেলা পঁচা আমের গন্ধে দূষিত হচ্ছে পরিবেশও।
সাপাহার উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, দিনাজপুর, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কয়েকটি উপজেলার হাজার হাজার চাষি সাপাহারে আম বিক্রি করতে আসেন। এই হাটে এক মৌসুমে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার আম বিক্রি হয়। এখানে তিন শতাধিক আমের আড়ত রয়েছে। আমাদের কাছে থাকা তথ্যমতে, অর্থনীতির দিক থেকে এটি দেশের সবচেয়ে বড় আমের হাট। আর আমকে কেন্দ্র করেই সাপাহারের অর্থনীতি সচল থাকে।

উপজেলা প্রশাসন বলছে, সাপাহার উপজেলার হাট এবার দুই কোটি টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। হাট ইজারা নিলেও আমের বাজার বসে মূলত সড়কের ওপর। এই সড়কের ওপর বসা হাট থেকে প্রতি মণ আমে ছয় টাকা করে খাজনা নেন ইজারাদারের লোকজন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আহমেদ বলেন, গত ১২ বছরে এই উপজেলায় ব্যাপকহারে আমবাগান বেড়েছে। মৌসুমে প্রতিদিন শত শত চাষি হাটে আম নিয়ে আসেন। হাটের মধ্যে জাগয়া না হওয়ায় সড়কের ওপরেই চাষিরা আম বিক্রি করেন।
তিনি বলেন, একদিকে পঁচা আম রাস্তার ওপর ফেলে দুর্গন্ধ ছড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে যানযটের ভোগান্তি সহ্য করতে হচ্ছে এই পথ ব্যবহারকারীদের। এখন আমের হাট বসানোর মতো বড় জায়গাও উপজেলায় নেই। বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে।