অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্বের প্রস্তাব

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য প্রণোদনার সঙ্গে বাজেটে স্বাস্থ্য সুরক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। দ্রুত সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনেটেড করার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বিপুল সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
বাজেটে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে যুক্ত করে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে চিকিৎসা ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার 'Macro Economy: Expectation from National Budget 2021-22' শীর্ষক এক আলোচনায় এসব প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ বাংলাদেশ (আইসিএবি) এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) যৌথ উদ্যোগে এ ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এমন সময় বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন যখন দেশে করোনার টিকা প্রদান অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ভারত থেকে আনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় ফেব্রুয়ারিতে শুরু টিকাদানও বন্ধ করে দেয় সরকার। ফলে পুনরুদ্ধারের আলোর মুখ দেখা অর্থনীতি আবার থুবড়ে পড়েছে।
অন্যদিকে আগামী অর্থবছরের জন্যও সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ানোর ঘোষণা আসেনি। সরকারের প্রস্তাবিত এডিপি প্রস্তাব অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র ৭.৭১ শতাংশ। যেখানে চলতি বছর ৫.৫ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে নানা সমালোচনা সব মহলে।
এসব কারণেই স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রণোদনার চেয়ে বেশি দরকার মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মুক্ত রেখে কাজের সুযোগ দেয়া।
এজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনতে আগামী বাজেটে কমপক্ষে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন তিনি।
খুব কম সময়ের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষকে টিকার অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে আগের অর্থনৈতিক অবস্থায় ফেরার প্রক্রিয়া আটকে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ।
তিনি বলেন, ভ্যাকসিন নেয়ার পর ৯ মাস তার কার্যকারিতা থাকে। একই সময়ে সব মানুষকে ভ্যাকসিনেটেড করে ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে না পারলে করোনা বারবার ফিরে আসবে।
দেশে বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করলে তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে সবাই মিলে স্বাস্থ্য খাতে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান।
স্বাস্থ্য খাতের পাশাপাশি শিক্ষায় বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে মন্তব্য করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী।
তিনি বলেন, 'জীবন জীবিকার পাশাপাশি দক্ষ মানব সম্পদ একটা গুরত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের চার কোটি শিক্ষার্থীর জীবন আটকে গেছে। শিক্ষা নিরাপত্তার জন্য সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। শিক্ষার ক্ষতি দৃশ্যমান হতে সময় লাগে এবং এর ক্ষতিটাও বেশ বড়। প্যান্ডেমিক ফোকাস বাজেট করলেও শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণায় বরাদ্দ দিতে হবে'।
খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক উদ্যোগ
স্বাস্থ্যের পাশাপাশি আগামী বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ধরে রাখা ও ক্ষুদ্র শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে মনে করছেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, করেনার কারণে দরিদ্র বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুরতা ও উদ্যোক্তাদের বিপদের কথা চিন্তা করে ক্ষুদ্র ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে বিশেষ বরাদ্দ রাখা ও কর্মসংস্থান বাড়ে এমন প্রকল্প নিতে হবে।
সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধবা ভাতাসহ নানা বরাদ্দের পাশাপাশি নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, 'পুনরুদ্ধার ও সংস্কারের জন্য আগে সমস্যাটা চিহিৃত করতে হবে। আগের বারের প্রণোদনা প্যাকেজগুলোতে ক্ষুদ্র শিল্পগুলো সুবিধা নিতে পারেনি'।
নতুন করে দরিদ্রদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে অন্তত এক হাজার কোটি টাকা বিতরণের প্রস্তাব দিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, প্রথম ঢেউয়ের সময় জেলা প্রশাসকদের মাত্র ৫০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। ফলে দরিদ্ররা সাহায্য পাননি। দরিদ্রদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দরকার।
খাদ্য নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি আগামী বাজেটে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে (এসএমই) বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ।
তিনি বলেন, 'করোনাকালীন এ সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সময় কর্মসংস্থান ধরে রাখার জন্য বাজেট হতে হবে'।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির ঘোর থেকে বের হওয়ার প্রস্তাব
সরকার অর্থনীতির সমস্যা সামনে না এনে জিডিপি প্রবৃদ্ধির চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে বলে মনে করছেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, 'আমাদের এতো বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির ঘোর তৈরী হয়ে গেছে! আমাদের জিডিপির তুলনায় কর অনুপাত ১৪ শতাংশ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা ৮.৫ শতাংশে আটকে আছে। আমাদের বিনিয়োগ জিডিপি অনুপাত ৩৪ হওয়ার কথা ছিল তা ২৮ এ। অর্থাৎ আমাদের ডিনমিনেটর [পুরোতে সমান অংশের সংখ্যা] বাড়ছে কিন্তু নিউমেরেটর [কয়টি অংশ বিবেচনা করা হচ্ছে] বাড়ছে না।
তিনি বলেন, 'কোভিড আসার আগেই আমাদের রপ্তানি, আমদানি ও রাজস্ব তে ধীর গতি দেখেছি। এ বিষয়গুলোকে এখনই চিহ্নিত করার সময়'।
বাজেট জিডিপি প্রবৃদ্ধি নয় ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানমুখী হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও বিল্ডের নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম খান।
তিনি বলেন, 'করোনায় মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে মানুষের ভোগব্যায় কমে গেলে উৎপাদন কমে যাবে। উৎপাদন কমে গেলে বেকার বেড়ে যাবে, অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাবে। ফলে জিডিপির দিকে নজর না দিয়ে ভোগ ব্যয় বাড়াতে মানুষের হাতে টাকা দিতে হবে'।
কর বৃদ্ধি নয় আওতা বাড়ানোর পরামর্শ
আগামী বাজেটে নতুন করে করারোপ না করে করপোরেট করহার কমানো, মিনিমাম ট্যাক্সের বাধ্যবাধকতা বাতিলসহ বেশ কিছু খাতে করহার কমানোর জোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, 'দেশে করপোরেট করহার যেকোন দেশের তুলনায় বেশি। বর্তমান করপোরেট করহার ৩২.৫ থেকে প্রতিবছর ২ শতাংশ করে কমিয়ে তিন বছরে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করছি'।
এনবিআরকে রাজস্ব বৃদ্ধি নয় কর নেট বৃদ্ধির জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান রিজওয়ান রহমান।
কোম্পানি লোকসানী হলেও টার্নওভারের দশমিক ৫ শতাংশ হারে ট্যাক্স দেয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয়ার দাবি করেন দ্য ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি রূপালী চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে বেসিস সভাপতি আলমাস কবীর বলেন, 'ভ্যাট ফাঁকি রোধ করলে রাজস্ব আহরন বাড়বে। এজন্য প্রযুক্তির ব্যবহারটা অত্যন্ত জরুরি। ৫ কোটি টাকার বেশি টার্নওভার হলেই একটা নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এ হার আরো বাড়বে'।
ডিভিডেন্টের ওপর কর কমানো এবং করপোরেট ট্যাক্স ধাপে ধাপে কমানোর দাবি করেছেন আমেরিকান চেম্বার অফ কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচ্যাম) সাবেক প্রেসিডেন্ট আফতাবুল ইসলাম।
কালো টাকা সাদার সুযোগ আর নয়
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার তীব্র বিরোধিতা করা হয় আলোচনা অনুষ্ঠানে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, 'আমি ৩০ বছর ধরে আয়ের ওপর ৩০-৩২ শতাংশ হারে কর দিয়ে আসছি। কিন্তু কালো টাকা উপার্জনকারীরা ১০ শতাংশ কর দিয়ে ওই টাকা বৈধ করার সুযোগ পাচ্ছে'।
'সৎভাবে আয় করে আমি কেন বেশি কর দেব' সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
অসৎ পথে আয়কে অপ্রদর্শিত আয় বলে বৈধ করার সুযোগকে 'এক ধরনের ধোঁকাবাজি' হিসাবে উল্লেখ করছেন ঢাকা চেম্বার সভাপতি রিজওয়ান রহমান।
তিনি বলেন, 'এ ধরনের সুযোগ অব্যাহত থাকলে আমরা বৈধ কর দাতারা ট্যাক্স দেয়া বন্ধ করে দেব'।
বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের যে সুবিধা দেয়া হয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত বলে মনে করছেন সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, 'এটি কর আহরণের যে নীতিকাঠামো তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদিও এ বছর ভালো একটি অঙ্ক এ খাত থেকে এসেছে। তারপরও আমরা মনে করি এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসা উচিত'।
দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সভাপতি মাহমুদুল হাসান খসরুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ইকোনমিকস রিপোর্র্টাস ফোরামের সভাপতি শারমিন রিনভি, সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম, আইসিএবি'র ভাইস প্রেসিডেন্ট মারিয়া হাওলাদার, দৈনিক প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন মাসুম প্রমুখ বক্তব্য দেন।