অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর: সাফল্যের সীমা ও অগ্রগতির অপূর্ণতা

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আর অব্যাহতভাবে কমেনি, বরং সামান্য বেড়েছে। মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমলেও চালসহ নিত্যপণ্যের দাম এখনও উঁচু। সবচেয়ে বড় স্বস্তির জায়গা হলো, অতীতের মতো বড় আকারের লুটপাট ও দুর্নীতি আর দেখা যায়নি। এসব সাফল্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সাফল্য কতটা টেকসই? বাস্তবতা হলো, বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখনো ফিরে আসেনি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা বিনিয়োগের পরিবেশকে স্থবির করে রেখেছে। ব্যক্তিখাতের প্রবৃদ্ধি কমছে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। ব্যাংকঋণের প্রবাহ সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিও হ্রাস পেয়েছে। এর সবকিছুর মূল কারণ অনিশ্চয়তা, যা বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তহীনতায় ঠেলে দিয়েছে।
একই সঙ্গে সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে বড় ফাঁক থেকে গেছে। শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্স রিপোর্টের মতো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলোর ভিত্তিতে বাস্তব কোনো কর্মপরিকল্পনা দেখা যায়নি। এক বছরে সব পরিবর্তন সম্ভব নয়, কিন্তু অন্তত প্রাথমিক পদক্ষেপ শুরু করা যেত। মন্ত্রণালয়গুলোকে যদি কর্মপরিকল্পনা করতে বাধ্য করা হতো, তাহলে ভবিষ্যত সরকারও সংস্কারের চাপ অনুভব করত। সেই সুযোগ হারানো হয়েছে।
জাতীয় বাজেটও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো কিংবা ব্যক্তিখাতের সমস্যাগুলো সমাধানের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে জনগণ যে ধরনের ভিন্নধর্মী বাজেট আশা করেছিল, তা আসেনি।
ব্যাংক খাতের সংস্কার প্রক্রিয়া এখনও অস্পষ্ট ও অস্বচ্ছ। কখনো বলা হচ্ছে পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হবে, কখনো ছয়টি। কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ নেই। ফলে জনগণ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না।
একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে, বিশেষ করে নতুন আইন ও বিধান প্রণয়নের মাধ্যমে খাতটিকে আধুনিক করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তায় আটকে আছে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এসব সংস্কার কতটা টেকসই হবে তা পুরোপুরি নির্ভর করছে আগামী সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এই উদ্যোগগুলো অপূর্ণ থেকে যাওয়ার ঝুঁকি বহন করছে, যা ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা গড়পড়তা অগ্রগতি ছাড়া আর কিছু নয়। রাজস্ব প্রশাসনকে আধুনিকায়ন ও করভিত্তি সম্প্রসারণের জন্য কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু পদক্ষেপ এসেছে খণ্ডিতভাবে।
এমনকি এনবিআরকে বিভক্ত করার উদ্যোগও বিতর্ক তৈরি করেছে, যেখানে কর্মকর্তাদের অসন্তোষ এবং স্বচ্ছতার অভাব নতুন করে আস্থার সংকট ডেকে এনেছে। ফলে রাজস্ব খাতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের বদলে অনিশ্চয়তা বেড়েছে।
সর্বোপরি, অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে অর্থনীতিতে আংশিক সাফল্যের আভাস পাওয়া গেলেও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং সংস্কার উদ্যোগের অপূর্ণতা ভবিষ্যতের জন্য শঙ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে। অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন আস্থা ফেরানো, স্বচ্ছ পরিকল্পনা ও সাহসী সংস্কার। অন্যথায় ইতিবাচক কিছু সাফল্যও টেকসই হবে না।