২০২৬ বিশ্বকাপের আয়োজক যখন উত্তর আমেরিকা; তখন খেলাটা কি ‘ফুটবল’ নাকি ‘সকার’?
ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর জন্ম সুইজারল্যান্ডে, যেখানে খেলাটির নাম 'ফুসবল' হিসেবে পরিচিত। তার পূর্বপুরুষের দেশ ইতালিতে আবার এটি 'কালচো'। অন্যদিকে, ফিফার পূর্ণাঙ্গ নামের মধ্যে আছে 'ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন'। আবার, দক্ষিণ ফ্লোরিডায় ফিফার কার্যালয়ের আশপাশে কান পাতলে শোনা যায় স্প্যানিশ উচ্চারণে 'ফুতবল'। কিন্তু এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে খেলাটির নাম শুধুই 'সকার'।
এই নাম নিয়ে বিতর্ক অবশ্য নতুন নয়। বছরের পর বছর এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে, তর্ক হয়েছে, এমনকি কূটনীতিকদের মধ্যে হাসিঠাট্টাও হয়েছে। বারাক ওবামা ও জো বাইডেন প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তা অ্যালেক্স ল্যাসরি বিদেশে গিয়ে 'সকার' শব্দটি ব্যবহার করে তিনি বেশ মজাই পেতেন।
ল্যাসরি বর্তমানে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি আয়োজক কমিটির প্রধান নির্বাহী। তার কাজ স্থানীয় দর্শকদের (যারা 'সকার' বলেন) কাছে টুর্নামেন্টের প্রচারণা চালানো এবং বিদেশিদের (যারা 'ফুটবল' বা 'ফুতবল' বলেন) স্বাগত জানানো।
ল্যাসরি বলেন, 'প্রচারণার ক্ষেত্রে সকার ও ফুটবল—দুটোই ব্যবহার করা হবে। ইউরোপের দর্শকদের আকৃষ্ট করতে গেলে নিশ্চিতভাবেই 'ফুটবল' বলতে হবে। তবে আমরা মাত্রাতিরিক্ত কিছু করতে চাই না। যুক্তরাষ্ট্রে বসে আমরা যদি সারাক্ষণ 'ফুটবল-ফুটবল' করি, তবে সেটা মেকি শোনাবে। যুক্তরাষ্ট্রে এটি তো সকার নামেই পরিচিত।'
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ আয়োজক কমিটি খেলাটিকে 'সকার' বললেও মায়ামির চিত্র ভিন্ন। ফিফার দপ্তরের কাছেই সেখানে আয়োজক কমিটির অফিস। কমিটির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা জানেল প্রিয়েতো বলেন, 'আমাদের এখানে নানা দেশের ও সংস্কৃতির মানুষ কাজ করেন। তাই নাম নিয়ে সারাক্ষণই তর্ক চলে।'
মজার ব্যাপার হলো, মায়ামির অফিসে অনেকে 'ফুটবল' বা 'ফুতবল' বলতে অনড় থাকলেও, 'সকার' বলার পক্ষে কেউ গোঁ ধরে বসে থাকেন না। প্রিয়েতো হেসে বলেন, 'অন্তত মায়ামিতে সকার শব্দটা খুব একটা চলে না।' মায়ামির মেয়র দানিয়েলা লেভিন তো স্প্যানিশে বলেই দিয়েছেন, 'এখানে আমরা ফুতবল বলব।'
এই নাম নিয়ে ফিফাকেও পড়তে হয়েছে বিড়ম্বনায়। তবে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বেশ চতুরতার সঙ্গে এই তর্কের সামাল দিচ্ছেন; নিউইয়র্ক, মায়ামি কিংবা হোয়াইট হাউস—যেখানেই যাচ্ছেন, সবখানেই তিনি কৌতুক দিয়ে পরিস্থিতি হালকা করছেন।
গত সেপ্টেম্বরে আটলান্টিক কাউন্সিলের এক অনুষ্ঠানে বিশ্বনেতাদের সামনে তিনি বলেন, 'আসুন, বিষয়টা পরিষ্কার করা যাক। আমরা যারা আমেরিকার বাইরে থাকি, তারা পা দিয়ে খেলি বলেই একে ফুটবল বলি। আর আপনারা হাত দিয়ে খেলে সেটাকে ফুটবল বলেন!'
এরপর হেসে ইনফান্তিনো বলেন, 'কে ঠিক আর কে ভুল, সেটা জানি না। আপনি সকার বলুন বা ফুটবল—আসল কথা হলো খেলাটা উপভোগ করা।'
অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, পা (ফুট) দিয়ে বল খেলা হয় বলেই এর নাম 'ফুটবল'। ফিফা সভাপতি ইনফান্তিনোও এমন ব্যাখ্যাই দেন। তবে ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। মধ্যযুগে ঘোড়ায় চড়ে খেলার চল ছিল। এর বিপরীতে পায়ে হেঁটে যে খেলা হতো, তাকেই বলা হতো 'ফুটবল'।
উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে রাগবি ফুটবল ও অ্যাসোসিয়েশন ফুটবল—এই দুই ধারার চল ছিল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুখে 'অ্যাসোসিয়েশন' শব্দটি ছোট হয়ে 'সকার'-এ পরিণত হয়। একসময় ইংল্যান্ডে 'সকার' শব্দটি হারিয়ে যায়, টিকে থাকে 'ফুটবল'। অথচ অদ্ভুতভাবে ব্রিটিশদের দেওয়া এই 'সকার' শব্দটিই আমেরিকায় স্থায়ী হয়ে যায়।
আমরিকায় 'ফুটবল' বলতে রাগবি ঘরানার আমেরিকান ফুটবলকেই (এনএফএল) বোঝানো হয়। সেখানে এনএফএল বা কলেজ ফুটবল তুমুল জনপ্রিয়। সিয়াটল আয়োজক কমিটির প্রধান নির্বাহী পিটার টোমোজাওয়া বলেন, 'আমেরিকান ফুটবল এতটাই জনপ্রিয় যে "ফুটবল" নামটা ওরা নিজেদের করে নিয়েছে।'
তবে এখন দিন পাল্টাচ্ছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের কল্যাণে অনেক আমেরিকান এখন 'ফুটবল' শব্দটিতে ঝুঁকছেন। বোস্টন আয়োজক কমিটির কর্মকর্তা জন পার্স বলেন, 'কেউ কেউ নিজেকে খুব আধুনিক বা অভিজাত প্রমাণ করতে সকারকে 'ফুটবল' বলেন। তখন মনে হয়, তারা যেন একটু ভাব দেখাচ্ছেন!'
যুক্তরাষ্ট্রের কোচ বা খেলোয়াড়দের কেউ কেউ মাঝেমধ্যে 'ফুটবল' ও 'সকার'—দুটো শব্দই ব্যবহার করেন। কিন্তু সাধারণ মার্কিনিদের কাছে 'ফুটবল' মানেই আমেরিকান ফুটবল (এনএফএল)। দেশটিতে এনএফএল-এর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। পরিসংখ্যানও তা-ই বলছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি মানুষ দেখেছিল ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ ফাইনাল (সকার), যার গড় দর্শক ছিল প্রায় ২ কোটি ৬৭ লাখ। অথচ এ বছর এনএফএলের সাধারণ ৬টি ম্যাচের দর্শকই ছিল এর চেয়ে বেশি। আর সর্বশেষ সুপার বোলের (এনএফএল ফাইনাল) দর্শক ছিল প্রায় ১২ কোটি ৭৭ লাখ, যা বিশ্বকাপ ফাইনালের দর্শকের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
সিয়াটল আয়োজক কমিটির প্রধান পিটার টোমোজাওয়া বলেন, 'এনএফএল এখানে যে ব্র্যান্ড তৈরি করেছে, তাকে সম্মান জানাতেই হবে। বিভ্রান্তি এড়াতে 'ফুটবল' নামটা ওদের জন্য ছেড়ে দিতে আমার আপত্তি নেই।'
ফিলাডেলফিয়া আয়োজক কমিটির প্রধান মেগ কেন বলেন, 'ফিলাডেলফিয়া ইগলসের (এনএফএল দল) কারণে এখানকার মানুষ আমেরিকান ফুটবলের ভক্ত। আমরা আমেরিকান ফুটবলকে সম্মান জানিয়েই প্রচারণার চেষ্টা করছি। তবে বিশ্ববাসী যে সকারকেই ফুটবল বলে, সেটাও মাথায় রাখছি।'
বোস্টন কমিটির জন পার্স ছোটবেলায় খেলেছেন আমেরিকান ফুটবল, কাজ করেছেন রাগবি নিয়ে, আর এখন কাজ করছেন বিশ্ব ফুটবল বা সকার নিয়ে। তিনি স্বীকার করেন, এই নাম নিয়ে মাঝেমধ্যে তিনিও গোলমাল পাকিয়ে ফেলেন। পার্স মজা করে বলেন, 'আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে কাজ করতে গিয়ে এখন সব সময় 'ফুটবল' শব্দটা ব্যবহার করি। মাঝেমধ্যে আমি নিজেই ভুলে যাই, আসলে কোন ফুটবলের কথা বলছি!'
অবশ্য ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো যখন কথা বলেন, তখন অবশ্য খুব একটা বিভ্রান্তি ছড়ায় না। তিনি 'ফুটবল' বলুন আর 'সকার'—সবাই বোঝেন তিনি তার সংস্থার খেলার কথাই বলছেন। সারা জীবন তিনি খেলাটিকে 'ফুটবল' বলেই এসেছেন।
কিন্তু ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালের আগেই তিনি ২০২৬ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) কথা মাথায় রেখে সুর পাল্টাতে শুরু করেন। তখন তিনি বলেছিলেন, 'ফুটবল বা সকার—সামনের বিশ্বকাপ যেখানে হচ্ছে, সেখানে খেলাটাকে যে নামেই ডাকা হোক—এর প্রভাব হবে বিশাল।'
যুক্তরাষ্ট্রে এখন নিয়মিত যাতায়াত ইনফান্তিনোর। ঝানু কূটনীতিকের মতো তিনিও স্থানীয় রীতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। বোস্টন কমিটির জন পার্স বলেন, 'কথা বলার সময় তিনি নিজেকে শুধরে নেন এবং সচেতনভাবেই 'সকার' শব্দটি ব্যবহার করেন।'
