অধিনায়কদের অধিনায়ক: মুশফিকের আদর্শ ধোনি

২০১১ থেকে ২০১৭; মুশফিকুর রহিমের অধিনায়কত্বকাল। এই সময়টায় সবচেয়ে বেশি শিখেছেন জাতীয় দলের অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার। ক্রিকেটবোধ পরিণত হয়েছে তার, মানুষ হিসেবে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন পরের ধাপে। তবে মুশফিকের 'মূল' বোধোদয়টা এসেছে অধিনায়কত্ব হারানোর পর।
অধিনায়কত্ব পালনের সময় অনেক কিছুই বলতে নেই; অধিনায়কত্ব হারিয়ে এটা বুঝতে পেরেছেন মুশফিক। দীর্ঘ সময় বাংলাদেশকে পথ দেখানো অভিজ্ঞ উইকেটরক্ষক এই ব্যাটসম্যান এটাও বুঝেছেন, অভিনয়টা জানলে অধিনায়কত্ব লম্বা হতে পারতো। এসব বুঝতে পেরে এখন আফসোসই হয় তার।
২০১৪ সালে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব হারান মুশফিক। ২০১৭ সালে এসে ছাড়তে হয় টেস্টের অধিনায়কত্ব। এই সাত বছরে কখনও রিকি পন্টিং, কখনও স্টিফেন ফ্লেমিং আবার কখনও মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো করে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছেন মুশফিক।
আপনার সেরা অধিনায়ক কে কিংবা কার মতো করে অধিনায়কত্ব করতে চাইতেন? এমন জিজ্ঞাসায় মুশফিকের উল্টো প্রশ্ন, 'রিকি পন্টিংয়ের মতো করে আক্রমণ করার রসদ আমার ছিল?' তাই আক্রমণাত্মক মনোভাব থাকলেও 'ডিফেন্সিভ' থেকে গেছেন তিনি।
ফ্লেমিংয়ের চতুরতা মনে ধরতো মুশফিকের, পন্টিংয়ের আকমণাত্মক মনোভাব। তবে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে নিয়ে তার বেশি মুগ্ধতা। ভারতের সাবেক অধিনায়ককেই আদর্শ মানেন তিনি। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিয়মিত আয়োজন 'অধিনায়কদের অধিনায়ক' সিরিজের তৃতীয় পর্বে এই তিন অধিনায়কের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন মুশফিক।
মুশফিকুর রহিম: আমার সেরা অধিনায়ক কে বা কাকে অনুসরণ করেছি, এটা বলার আগে আমার কিছু কথা বলতে হবে। হয়তো সেই কথাগুলো বেশি হবে। তবু আমি বলতে চাই। অধিনায়ক হিসেবে সবার একটা দর্শন থাকে। সহজাত প্রবৃদ্ধির একটা ব্যাপার থাকে। কেউ যুক্তির ওপর চলতে চায়, কেউ সাহস নিয়ে চলতে চায়। আবার কেউ নির্দিষ্ট অবস্থা নিয়ে চলতে চায়।
নেতৃত্ব দিতে রসদের দরকার হয়। বোলার বা ওই রকম ব্যাটসম্যান, যাদের নিয়ে আপনি গেম্বলিং করতে পারবেন বা যাদেরকে নিয়ে আপনি অনেক আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজাতে পারবেন, এমন ক্রিকেটার থাকতে হয়। আমার মনেহয় আমি কিছুটা দুর্ভাগা যে আমার সময়ে লড়াইয়ের যথেষ্ট রসদ ছিল না, যা আমি প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কাজে লাগাতে পারি।
আমার অনেক সময় রক্ষণশীল সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এ জন্য আমাকে অনেক কথাও শুনতে হয়েছে। আমার কাছে সেই আয়েশ বা বিলাসিতা ছিল না। যেকোনো অধিনায়কই চায় আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজাতে, আক্রমণ করতে। কিন্তু আবার আক্রমণ করলেই যে সব সময় ফল হয়, সেটাও না। কারণ আপনার কাছে যদি সেই সৈন্য না থাকে তাহলে কিন্তু কঠিন। পরে সবগুলো মরবে, আপনিও মরবেন। এই জিনিসগুলো আমার কাছে ছিল না। এটা খুবই বড় বিষয়।
আমার সময়ে সাকিব আর মাশরাফি ভাই ছাড়া এক্সট্রা অর্ডিনারি কেউ ছিল না। যে কিনা ওই রকম অবস্থা তৈরি করতে সাহায্য করবে। স্পেশালি টেস্ট ক্রিকেটে, কারণ মাশরাফি ভাই টেস্ট ক্রিকেট খেলতেন না। একমাত্র সাকিব ছাড়া কেউ ছিল না। প্রতিপক্ষও জানে সাকিব যতক্ষণ আছে, আমাকে কষ্ট করতে হবে। এরপর অন্য বোলার আসবে এবং আমি সহজেই স্কোর করতে পারব।
যেটা কিনা অন্যান্য অধিনায়কের কাছে ছিল। যেমন মুস্তাফিজ, মিরাজ, তাইজুল ছিল। রুবেল অনেক অভিজ্ঞ হয়েছে এখন। শফিউল, আল আমিন বা পরে যারা এসেছে তাসকিন। তো আমি মনে করি দুর্ভাগা ছিলাম। শেষ চার-পাঁচ বছর অনেক সহজ হয়েছে। তারাও অনেক অভিজ্ঞ হয়েছে, বাংলাদেশ দলের জন্য নিয়মিত অবদান রাখতে পেরেছে।
অধিনায়ক হিসেবে আদর্শ বলতে বললে আমার ওই রকম কোনো নির্দিষ্ট একজন আদর্শ নেই। আমার একেকজনের একেকরকম ক্রিকেটিং সেন্স বা ব্রেন বা আচরণ ভালো লাগে। স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের অধিনায়কত্ব আমার ভালো লাগতো। এরপর রিকি পন্টিংয়ের আক্রমণাত্মক ব্যাপারটা ভালো লাগতো।
এখন যদি আপনি রিকি পন্টিংকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে বলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব করতে হবে, তুমি এমন আক্রমণ করবে। আমি মনে করি না ও কখনও এসে সেটা করতে পারবে। কারণ এখানে গ্লেন ম্যাকগ্রা বা শেন ওয়ার্নের মতো বোলার নেই। ব্রেট লির মতো ১৪৫-৪৮ কি.মি বেগে বল করার বোলারও আমার ছিল না।
কেউ এসে ওইরকম আয়েশ করতে পারবে না। মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো, যার কাছে অশ্বিন, জাদেজা বা ভুবনেশ্বর, শামি, ইশান্ত, হরভজন, জহির খানের মতো এমন বিশ্বমানের বোলার ছিল, আমাদের তখন ছিল না। আপনার কী রসদ আছে, তার ওপর নির্ভর করে আপনাকে গেম প্ল্যান করতে হয়।
ধোনির অধিনায়কত্ব আমার ভালো লাগে। কারণ সর্বকালের সেরা অধিনায়কের মধ্যে তার নাম থাকবে বলে আমি মনে করি। তার সিক্স সেন্স অনেক ভালো, আগে থেকে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে সে। তার ক্রিকেটিং সেন্সও অনেক ভালো। তার জয়ের গড়, পরিসংখ্যান অনেক ভালো। এমন কোনো বড় টুর্নামেন্ট নেই, সে জেতেনি। সে আমার ভালো লাগার অধিনায়ক। শুরুতে বলেছি তেমন আদর্শ নেই, তবে ধোনিকে আমার আদর্শ বলতে পারেন। আমি মনে করি বিশ্ব ক্রিকেটেই অন্যান্য অধিনায়কদের জন্য সে আদর্শ।
আমি যাদের নাম বললাম স্টিফেন ফ্লেমিং, রিকি পন্টিং বা ধোনি, সবার মতোই আমার আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্ব করতে মন চাইতো। ওভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমার কাছে সেই রসদ ছিল না, আমি সেটা পারিনি। এ জন্য অবশ্যই আমার কাছে খারাপ লাগে। আমি চেষ্টা করেছি নিজের পারফরম্যান্স দিয়েও সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার। সেটা অনেক সময় হয়েছে, অনেক সময় হয়নি।
কিন্তু আমাদের তো ভারত, নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মতো টপ পারফরমার নেই যে, তারা খেলাটাকে সহজ করে দেবে। আপনার অধিনায়কত্বকে অনেক সহজ করে দেবে। আমার মনে হয় আমি এটা পাইনি। প্রশ্ন করতে পারেন মাশরাফি ভাই কীভাবে পারলেন। আমি মনেকরি সে আমার চেয়ে অবশ্যই অনেক ভালো, এটা আমি কখনই অস্বীকার করিনি।
তার ক্রিকেটিং সেন্স, মাঠ ও মাঠের বাইরে; সবকিছুই আমার চেয়ে ভালো। এই জন্যই সে পেরেছে। আবার তার আয়েশ ছিল, তিনি ভালো ভালো কিছু ম্যাচ উইনার পেয়েছেন। যেটাকে তিনি ব্যবহার করতে পেরেছেন। আমি হয়তো সেটা পরিনি।