মুশফিকের বিদায়ে সতীর্থদের আবেগী বার্তা

সাম্প্রতিক ফর্ম ভালো ছিল না, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সময় কেটেছে দুঃস্বপ্নের। ওয়ানডের পথচলাটা তাই দীর্ঘ করেননি মুশফিকুর রহিম। বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ফরম্যাট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলেন মুশফিক। সেবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। সতীর্থরাও নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এখানে, মুশফিককে জানিয়েছেন শুভ কামনা।
২০০৬ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় মুশফিকের। এর পর দীর্ঘ ১৯ বছরে দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ২৭৪টি ম্যাচ খেলেছেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। ৯টি সেঞ্চুরি ও ৪৯টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩৬.৪২ গড় ও ৭৯.৭০ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ৭ হাজার ৭৯৫, যা বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সেঞ্চুরিতেও যৌথভাবে দ্বিতীয় সেরা তিনি।
এই ফরম্যাটের দীর্ঘ পথচলায় মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে সর্বোচ্চ ৮২টি ম্যাচ খেলেছেন মুশফিক। তার বিদায়ে আবেগী পোস্ট দিয়েছেন দেশের ওয়ানডে ইতিহাসের সফলতম অধিনায়ক। মাশরাফি লিখেছেন, 'তোমার বিদায়ের ঘোষণায় এক লহমায় অনেক কিছু ভেসে উঠল চোখে। এতো বছরের একসঙ্গে পথচলা, মাঠের ভেতরে-বাইরে কতশত স্মৃতি! ওয়ানডেতে তোমার রেকর্ডই তোমার হয়ে স্বাক্ষ্য দেবে অনেক কিছুর। তোমার ব্যাটের দ্যুতিতে কতো আলোর দিন এসেছে দেশের ক্রিকেটে!'
'রেকর্ড বইয়ে লেখা থাকবে না, কতোটা নিবেদন আর নিষ্ঠায় তুমি ক্যারিয়ার গড়েছিলে, কতোটা ঘামের স্রোত পেরিয়ে সাফল্যের তীর ছুঁয়েছিলে। তোমার পরিশ্রম, প্রতিজ্ঞা আর ত্যাগের গল্প বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রজন্মের পর প্রজন্মে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। আশা করি, সাদা পোশাকের বাকি অধ্যায়টুকু রঙিন করে তুলবে। তোমার ব্যাটে অভিজাত সংস্করণে দেশের ক্রিকেট সমৃদ্ধ হবে আরও...।' লেখেন মাশরাফি।
মুশফিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তামিম ইকবাল, বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে এক সঙ্গে খেলে আসছেন তারা। বন্ধুর অবসরের ঘোষণায় আবেগী বার্তা দিয়েছেন তিনিও। ভিডিওবার্তায় তামিম বলেন, 'আজ আসলে এমন একটা দিন... সাধারণত কেউ যদি কোনো সংস্করণ থেকে অবসর নেয়, সবাই স্ট্যাটাস দেয়, নিজের অনুভূতি বোঝায়। কিন্তু এমন একজন ব্যক্তি আজ অবসর নিল, যার সঙ্গে আমার ২০-২৫ বছরের যাত্রা।'
'একটা স্ট্যাটাসে আমি বোঝতে পারতাম না, তার প্রতি আমার অনুভূতিটা কী বা আমার এখন কেমন অনুভূত হচ্ছে। মুশফিককে এতোটুকুই বলতে চাই, 'দোস্ত তোর সঙ্গে আমার খেলার শুরু অনূর্ধ্ব-১৫ পর্যায় থেকে। আমি তোকে ধাপে ধাপে বেড়ে উঠতে দেখেছি। একজন সাধারণ ব্যাটসম্যান থেকে কীভাবে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান হয়েছিস, সেটা আমি দেখেছি।' বলেন তামিম।
মুশফিকের ত্যাগ, পরিশ্রম, নিবেদন নিয়ে তামিম বলেন, 'অনেক মানুষের হয়তো ওর কঠোর পরিশ্রম দেখার সুযোগ হয়নি। আমরা যেহেতু একসঙ্গে খেলি, আমি দেখেছি একটা ছেলে কতটা কষ্ট করতে পারে। একটা মানুষের পক্ষে যতটা কষ্ট করা সম্ভব, আমার মনে হয় সে সবই করেছে। এখনও করে যায়। আমরা অনেক সময় এটা নিয়ে হাসাহাসিও করি যে, একটা মানুষ এতো কষ্ট করে কেন! তবে তার নিবেদন, খেলার প্রতি ভালোবাসা অসীম। এটা আমি কথায় কাউকে কোনোদিন বোঝাতে পারব না।'
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের চোখে মুশফিক কিংবদন্তি, পোস্টে 'কিংবদন্তি' হ্যাশট্যাগ দিয়েছেন তিনি। মুশফিককে দেশের ক্রিকেটের অমূল্য রত্ন হিসেবে উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, 'প্রিয় মুশফিক, দুর্দান্ত ওয়ানডে ক্যারিয়ারের জন্য অভিনন্দন। দুবাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ভাঙা পাঁজর নিয়ে করা সেই শতক এখনও মনে আছে। খেলাটির প্রতি সম্মান, নিষ্ঠা এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে পারফর্ম করার কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতার প্রতিফলন এটি। যা যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। কোনো সন্দেহ নেই, তুমি বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক অমূল্য রত্ন। তোমার টেস্ট ক্রিকেটের যাত্রার জন্য শুভ কামনা।'
নাজমুল হোসেন শান্তর নেতৃত্বে ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে খেলেছেন মুশফিক। বর্তমান বাংলাদেশ অধিনায়কের বিশ্বাস, বাংলাদেশ ক্রিকেটে মুশফিকের অবদান সবসময় মনে রাখা হবে, 'আমাদের লাখো মানুষের অনুপ্রেরণা হওয়ার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় মুশফিক ভাই। সত্যিকারের টিম ম্যান আপনি। খেলাটির প্রতি আপনার নিবেদন আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের সামনের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট কখনোই আপনার অবদান ভুলবে না।'
তাসকিন আহমেদ মনে করেন, মুশফিককে ছাড়া ওয়ানডেতে বাংলাদেশ দলকে কল্পনা করাও কঠিন। দলের পেস আক্রমণের নেতা লিখেছেন, 'একটি যুগের সমাপ্তি! মুশি ভাই, আপনাকে ছাড়া বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেট কল্পনা করা কঠিন। আপনার নিবেদন, আত্মত্যাগ ও লড়াকু মানসিকতা সবার জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। আপনার সঙ্গে মাঠে খেলা ও শেখার সুযোগ পাওয়া সত্যিই গর্বের বিষয়। আপনার আগামী অধ্যায়ের জন্য শুভকামনা। আপনার লিগ্যাসি চিরকাল বেঁচে থাকবে!'
মুশফিকের অধিনায়কত্বে ২০১৪ সালে ওয়ানডে অভিষেক হয় তাইজুল ইসলামের। সেই স্মৃতি মনে করে বাঁহাতি এই স্পিনার তার বিদায়ী বার্তায় লিখেছেন, 'প্রিয় মুশি ভাই, আপনার অধিনায়কত্বেই আমার রঙিন পোশাকের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যদিও যাত্রাটা খুব একটা লম্বা হয়নি একসাথে। তারপরও কিছু অর্জনের মূহুর্ত আছে একসাথে যা সারাজীবন স্মরণ থাকবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটকে আপনি অনেক কিছু দিয়েছেন। রঙিন পোশাকে আপনাকে আর দেখা হবে না, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।'
মুশফিকের মতোই তাওহিদ হৃদয়ের বেড়ে ওঠাও বগুড়ায়। নিজ জেলার বড় ভাইকে আদর্শ মেনে ক্রিকেটার হওয়া এই ব্যাটসম্যান মুশফিকের সঙ্গে খেলার স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, 'বগুড়া স্টেডিয়ামে আপনি প্র্যাকটিস করছেন শুনে ছোটবেলায় আপনাকে দেখার আশায় স্টেডিয়ামের গেটের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে শুরু করে, ওয়ানডের আন্তর্জাতিক ক্যাপ আপনার হাত থেকে গ্রহণ করা এবং একই ড্রেসিং রুম শেয়ার করা- আমার কাছে রূপকথার গল্পের থেকে কম নয়!'
'এ রকম লাখো ছেলেদের আইডল আপনি, যার জন্য আমার মতো অনেকেই আপনাকে একবার দেখবে বলে কতো দিন অপেক্ষা করেছে! আপনি আমার আইডল, কতোটা গুরুত্বপূর্ণ আপনি তা হয়তো বুঝতেও পারবেন না। যদিও আমি বাকরুদ্ধ, হতবাক... তবুও অবসরের জন্য শুভকামনা আমার আদর্শ মুশফিকুর রহিম। আপনাকে যে কারও চেয়ে, যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি মিস করব।' লেখেন তিনি।
পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুশফিকের গল্প করবেন জানিয়ে তরুণ লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন বিদায়ী বার্তায় লিখেছেন, 'মাঠে খেলতে স্কিলের পাশাপাশি অনুপ্রেরণা খেলাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। আপনি স্টাম্পের পেছনে অথবা অফ স্ট্রাইকে থেকে যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন, সাহস দিয়েছেন, গাইড করেছেন, সেটা ইমার্জিং প্লেয়ারদের কাছে পাওয়ার হিলিং-এর মতো। আপনার ক্যারিয়ারের ১৯ বছরে অনেক অল্প সময় আপনার সাথে টিম শেয়ার করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে আপনার থেকে যা শিখেছি সেটা অবশ্যই আমাদের পরবর্তী জুনিয়রদের সাথে গল্প করব।'