এফিডেভিট কী, কেন ও কীভাবে করবেন?

প্রাত্যহিক জীবনে অনেক সময় এফিডেভিটের প্রয়োজন হয়ে থাকে। সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট ইত্যাদিতে নিজের নাম কিংবা মাতা-পিতার নামের ভুল সংশোধন, বয়স সংশোধন ইত্যাদি কারণে প্রায়ই এফিডেভিট বা হলফনামার প্রয়োজন হয়।
এফিডেভিট (Affidavit) হল একটি লিখিত অঙ্গীকারনামা, যা শপথ করে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সামনে সত্য বলে ঘোষণা করা হয়। এটিকে হলফনামাও বলে। এফিডেভিট সময়ে সময়ে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প পেপারের ওপর হাতে লিখে বা কম্পিউটারে কম্পোজ করে তৈরি করা হয়।
এফিডেভিট সংক্রান্ত আইন
১৯৬১ সনের নোটারি অধ্যাদেশ দ্বারা বাংলাদেশে নোটারি পাবলিকের প্রচলন শুরু হয়। এর আগেও নোটারি পাবলিক ছিল, কিন্তু সেটি অন্য আইন দ্বারা নিযুক্ত হতো। কোনো নোটারি পাবলিক বা ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ বা কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ বা কমিশনার হলফগ্রহণ করতে পারেন। সাধারণত 'আমি প্রতিজ্ঞাপূর্বক বলিতেছি' বা 'আমি হলফ করিয়া বলিতেছি' মর্মে স্ট্যাম্পে কোনো কিছু লেখাকে ও দস্তখত করাকে এফিডেভিট বা হলফনামা সম্পাদন করা বলে। সেক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ উক্ত দস্তখত সত্যায়ন করাকে নোটারি করা বলে। সত্যায়নের বিনিময়ে নোটারি পাবলিক ওই ব্যক্তির নিকট থেকে টাকা নিতে পারেন।
এফিডেভিট করতে কত টাকা লাগে
এফিডেভিটের স্ট্যাম্পে টাকার পরিমাণ এবং চুক্তির বিভিন্ন ধরনের ওপর নোটারি পাবলিক আপনার কাছে অর্থ দাবি করতে পারেন। সেটি ১০০ থেকে ১,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও, বিভিন্ন ধরনের নোটারি রয়েছে, ধরনভেদে খরচ কম বেশি হতে পারে। এফিডেভিটে স্ট্যাম্পের খরচ ধরনভেদে ৩০০-২,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
এফিডেভিট বা হলফনামা পদ্ধতি
যে বিষয়ে আপনি ঘোষণা দিতে ইচ্ছুক, অর্থাৎ যে কারণে আপনি এফিডেভিট করবেন, তা অবশ্যই ধরনভেদে ৩০০-২,০০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে কোনো বিজ্ঞ আইনজীবী দিয়ে লিখিয়ে নিতে হবে। নিজে নিজে লিখতে পারেন, তবে তাতে আইনজীবীর স্বাক্ষর অবশ্যই লাগবে। সুতরাং, আইনজীবীকে দিয়ে লিখিয়ে নিলে ঝামেলা কমবে।
এবার হলফনামায় ছবি সংযুক্ত করে এফিডেভিট বা হলফনামা প্রদানকারী ব্যক্তি এফিডেভিটের নির্ধারিত স্থানে স্বাক্ষর দিয়ে হলফনামার শেষাংশে আইনজীবীর সত্যায়ন লাগবে। সবশেষে এখতিয়ার সম্পন্ন কোনো প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট, নোটারি পাবলিক, কমিশনার অথবা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থাপন করতে হয়। তারা এফিডেভিটটি গ্রহণ করে মূল স্ট্যাম্পে রেজিস্ট্রি নম্বর বসিয়ে তাতে স্বাক্ষর ও সিল প্রদান করবেন।
যা যা প্রয়োজন
এফিডেভিটকারীর নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার, ছবি ও ৩০০-২,০০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প। যে ঘটনার জন্য এফিডেভিট করা হচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
এফিডেভিট করার সময় প্রদত্ত তথ্য সত্য হওয়া আবশ্যক। ভুল তথ্যের জন্য আপনাকে দায়ী করা হতে পারে। এতে নোটারি পাবলিক কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো দায় থাকবে না। তবে আপনার স্বাক্ষরের জন্য নোটারি পাবলিক বা ম্যাজিস্ট্রেট দায়ী থাকবেন। কেননা আপনি তার সম্মুখে দস্তখত করেছেন এমন কথা উল্লেখ করতে হয়।
বোঝার সুবিধার্থে এফিডেভিট বা হলফনামার একটি নমুনা (কাল্পনিক) নিচে দেওয়া হলো—
"নোটারী পাবলিক-এর কার্যালয়, ঢাকা, বাংলাদেশ ।
'তালাকের হলফনামা'
আমি রাশিদা সুলতানা, পিতা- আব্দুল গফুর, মাতা- আমেনা বেগম, জন্মতারিখ- ০০-০০-২০০২, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর: ০০০ ০০০ ০০০০, ঠিকানা-বাসা নং- ২০৪/৩/ট, সেগুনবাগিচা, থানা- শাহবাগ, জেলা-ঢাকা-১০০০, পেশা- ব্যবসা, ধর্ম-ইসলাম, জাতীয়তা- বাংলাদেশী এই মর্মে হলফপূর্বক ঘোষণা করিতেছি যে—
১। আমি বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকারে একজন স্থায়ী বাসিন্দা বটে। আমি সুস্থ ও হলফনামা সম্পাদন করিবার উপযুক্ত বটে।
২। সুলতান সোলেমান, পিতা- মেছের সুলতান, মাতা- আকলিমা খাতুন ,বয়স-২৬ বৎসর, ঠিকানা-বাসা নং-১০০/১/ক কাঁঠাল বাগিচা, থানা- রমনা, ঢাকা-১০০০ এর সাথে আমার বিগত ২ বৎসর পূর্বে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। প্রথম দিকে আমার সংসার ভাল চলছিল।
৩। কিন্তু বছর না যেতেই তার আসল রূপ বেরিয়ে আসে। সে কথায় কথায় আমাকে মারধর করে। প্রতিবাদ করলে যখন তখন তালাকের হুমকি দেয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমার স্বামী পরকীয়ায় আসক্ত ও নেশাগ্রস্ত। সে আমাকে ভরণপোষন ঠিকমতো দেয় না। দুজনের মধ্যে বনিবনা হয় না। নেশার টাকা আমার বাবার বাড়ি থেকে এনে দেওয়ার জন্য মারধর করে। তাকে বোঝালেও বোঝে না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, আমাকে যেকোনো মুহূর্তে প্রাণেও মেরে ফেলতে পারে। এমন স্বামীর সাথে একসাথে ঘর সংসার করা এককথায় অসম্ভব।
৪। তাই আমি কাবিননামার ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে আমার স্বামী সুলতান সোলেমানকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এক্ষণে তালাকে তাফউইজ উচ্চারণ করিয়া আমি আমার নিজ নফসের প্রতি তালাক গ্রহণ করে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করিলাম।
৫। অদ্য হইতে উক্ত সুলতান সোলেমান আমার স্বামী নহে। আমিও তার স্ত্রী নই। ভবিষ্যতে কেউ কাহাকেও স্বামী বা স্ত্রী দাবি করিতে পারিব না। করিলেও তাহা সর্বাদালতে অগ্রাহ্য হইবে।
উপরোক্ত ঘোষণা স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে অন্যের বিনা প্ররোচনায় সম্পূর্ণ ও নির্ভুলভাবে অত্র হলফনামার বর্ণনা সম্যক উপলব্ধি করিয়া মাননীয় নোটারি পাবলিক এর সম্মুখে অদ্য নিজ নাম সহি সম্পাদন করিলাম।
হলফকারিনীর স্বাক্ষর
স্বাক্ষীদের নাম ও ঠিকানা
১।
২।
আমি হলফকারী রাশিদা সুলতানাকে চিনি। তিনি আমার সম্মুখে দস্তখত করিলে আমি তাকে শনাক্ত করিলাম।
আইনজীবীর স্বাক্ষর
তারিখ:"
আরিফুল ইসলাম: আইনজীবী
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।