বিতর্কের বিষয়: সেক্যুলারিজম বনাম প্লুরালিজম

সম্প্রতি আমাদের দেশে সেক্যুলারিজম (ইহলৌকিকতা) এবং প্লুরালিজম (বহুত্ববাদ) নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। শুরুতে জাতীয় নাগরিক কমিটি বহুত্ববাদের পক্ষ নিলেও, তাদের সৃষ্ট রাজনৈতিক দল এনসিপি বহুত্ববাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী ও বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবীগণ সেক্যুলারিজমের পক্ষে কথা বলছেন। জামাতসহ ইসলামপন্থি দলগুলো দুটোরই বিপক্ষে। বামপন্থীগণ যথারীতি তাদের তথাকথিত "অমীমাংসিত দ্বান্দিক বস্তুবাদী ধারণা" থেকে সেক্যুলারিজমকে আঁকড়ে ধরে বহুত্ববাদের সমালোচনা করার চেষ্টা করছেন।
সেক্যুলারিজম ও বহুত্ববাদের ধারণা দুটি একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হলেও কিছুটা ভিন্নতর। এখানে সেগুলোর বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা হলো:
আমাদের দেশে সেক্যুলারিজমের বাংলা অনুবাদ করা হয় "ধর্মনিরপেক্ষতা", আমার জানামতে এটি সঠিক অর্থ নয়। আসলে সেক্যুলারিজম শব্দের সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ নাই, তবে "ইহলৌকিকতা" সেক্যুলারিজমের কাছাকাছি অর্থ বহন করে। সেক্যুলারিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নবিধ:
- রাষ্ট্র ধর্মীয় বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকে।
- রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে প্রাধান্য দেয় না কিংবা অবজ্ঞা করে না।
- প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম পালন বা না পালনের স্বাধীনতা থাকে।
- ধর্মীয় প্রভাব রাষ্ট্রীয় আইন বা শিক্ষায় থাকে না।
- রাষ্ট্র নিজেই ধর্ম থেকে স্বাধীনতা (freedom from religion) নিশ্চিত করে।
উদাহরণ: ফ্রান্স – যেখানে ধর্মীয় প্রতীক সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ।
"প্লুরালিজম" বা বহুত্ববাদ হল একটি সমাজে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতি ও মতাদর্শের সহাবস্থান ও পারস্পরিক সম্মান বজায় রেখে বসবাসের ধারণা। এর মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ:
- বিভিন্ন মত ও বিশ্বাসের সহাবস্থান।
- পারস্পরিক সহনশীলতা ও সংলাপকে উৎসাহ দেয়।
- ধর্ম পালন বা প্রকাশের স্বাধীনতা (freedom of religion) নিশ্চিত করে।
- সমাজকে বৈচিত্র্যময় ও অংশগ্রহণমূলক করে তোলে।
উদাহরণ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া–যেখানে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উদযাপন করা হয় এবং নানা ধর্মাবলম্বীরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারেন।
রাষ্ট্র ও সমাজে সেক্যুলারিজম এবং বহুত্ববাদ একসাথেও চলতে পারে–যেখানে সেক্যুলারিজম রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ রাখে, এবং বহুত্ববাদ সেই নিরপেক্ষ কাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন মত ও বিশ্বাসের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে সম্ভব করে তোলে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি বাংলাদেশর জন্য সেক্যুলারিজমের চাইতে বহুত্ববাদের বেশী যুতসই হবে। কারণ আমাদের সংস্কৃতি সেক্যুলারিজমের উপযুক্ত নয়। নিকট অতীতে আমরা ভারতের অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই সেখানে সেক্যুলারিজম থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে হিন্দুত্ববাদ চালু হয়েছে।
সমাজ যখন সেক্যুলারিজমকে ধারণ করতে পারে না, সেখানে একে চাপিয়ে দিলে বিপরীত ফল পাবার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। ভারতের উদাহরণ বিচারে আমাদের দেশের জন্য বহুত্ববাদের প্রয়োগ একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী বিষয়।
একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ হিসেবে, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী, ভাষা ও সংস্কৃতি সহাবস্থান করছে, সেখানে বহুত্ববাদ সমাজকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহনশীল করতে পারে।
বাংলাদেশে বহুত্ববাদের প্রয়োগ মানে হলো—একটি এমন সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে ধর্ম, জাতি, ভাষা, মতাদর্শ, লিঙ্গ—সব ধরনের বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা ও মর্যাদা দেওয়া হয়। এটি কেবল সংবিধানের আলোকে নয়, সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় বহুত্ববাদ কেমন হতে পারে?
১. ধর্মীয় সহাবস্থান: বাংলাদেশের জনগণের বৃহৎ অংশ মুসলিম, তবে এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং আদিবাসী ধর্মাবলম্বীরাও আছেন। বহুত্ববাদ নিশ্চিত করবে:
- ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি নির্বিশেষ সকল নাগরিক সমান মর্যাদা ও অধিকার।
- ধর্মীয় উৎসব উদযাপনে বাধা না দেওয়া হয়।
- অবিশ্বাসীর ওপর ধর্ম যাতে চাপিয়ে না দেয়া হয়।
- সংখ্যালঘু ব্যাক্তি যেন রাষ্ট্রীয় সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন।
- ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা।
উদাহরণ: পূজার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ধর্মীয় উপাসনালয় রক্ষায় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ।
২. জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য
বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতাল, হাজংসহ বহু আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস আছে। বহুত্ববাদ এখানে সহায়ক হতে পারে:
- তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ করতে।
- মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে।
- আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্য রোধে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে।
৩. বহুত্ববাদ রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য:
- ভিন্ন মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা।
- বিরোধী দলের প্রতি সহনশীল মনোভাব।
- সাংবাদিকতা ও মুক্ত মত প্রকাশে বাধা না দেওয়া।
৪. বহুত্ববাদ লিঙ্গ বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয়:
- নারী, তৃতীয় লিঙ্গ ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা।
- কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষায় ও নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৫. বাস্তব চ্যালেঞ্জসমূহ
- সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের ওপর সহিংসতা বা বৈষম্য।
- আদিবাসীদের জমি ও সাংস্কৃতিক অধিকার লঙ্ঘন।
- ভিন্নমত দমনে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক প্রতিক্রিয়া।
- নারী ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যের বিরুদ্ধে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।
বাংলাদেশে বহুত্ববাদ প্রয়োগের উপায়:
- শিক্ষার মাধ্যমে সহনশীলতা শেখানো।
- পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের গুরুত্ব তুলে ধরা।
- আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।
- সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা।
- রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্যের প্রতিফলন, সব ধর্ম, জাতি ও গোষ্ঠীর মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
- গণমাধ্যমে ইতিবাচক প্রচার।
- বহুত্ববাদী সমাজের ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।