পূর্ণাঙ্গ স্যুয়ারেজ নেটওয়র্কের আওতায় আসছে চট্টগ্রাম, ওয়াসার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রাজস্ব আদায়
চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় একের পর এক বড় প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় দেশের প্রথম নগরী হিসেবে চট্টগ্রামে পূর্ণাঙ্গ স্যুয়ারেজ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সিস্টেমটি চালু হওয়ার পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সঠিকভাবে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করা।
মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী পুরো নগরীকে ছয়টি ক্যাচমেন্টে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে চারটি ক্যাচমেন্টে ১৫,৩৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাকি দুটি ক্যাচমেন্টের জন্য আরও ১৩,২৫৮ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় আছে।
প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগ অর্থায়ন আসছে বিদেশি ঋণ থেকে। ফলে আগামী বছরগুলোতে স্যুয়ারেজ সেবা থেকে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করার চাপ আরও বাড়বে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, উন্নত দেশগুলোর মতোই পানি ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে স্যুয়ারেজ বিল নির্ধারণ করা হবে। অর্থাৎ, বাসাবাড়িতে যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করা হবে, স্যুয়ারেজের হিসাবেও একই পরিমাণ ধরা হবে। যেসব বাসাবাড়িতে ওয়াসার পানি সংযোগ নেই, সেসব স্থাপনায় সরকারি স্যুয়ারেজ ট্যারিফ নীতিমালা অনুযায়ী ফ্ল্যাট হিসেবেই বিল করা হবে। তবে অ-রাজস্বভুক্ত পানি ও অবৈধ সংযোগের ক্ষেত্রে বিল আদায় করা ওয়াসার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম টিবিএসকে বলেন, "পানির রাজস্ব সঠিকভাবে আদায় না হলে স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনাতেও ব্যাঘাত ঘটবে।"
তিনি আরও বলেন, "প্রাথমিকভাবে ওয়াসার পানির গ্রাহকরাই স্যুয়ারেজ সেবা পাবেন। যেখানে পানির সংযোগ থাকবে না, সেখানে সেপটিক ট্যাংক থেকে ভ্যাকুয়াম ট্রাকের মাধ্যমে ফিক্যাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে বর্জ্য আনা হবে।"
বহুল প্রতীক্ষিত স্যুয়ারেজ প্রকল্প এখন বাস্তবায়নের পথে
চট্টগ্রাম ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যুয়ারেজ অথরিটির (সিডব্লিউএএসএ) নামের সঙ্গে 'স্যুয়ারেজ' শব্দ যুক্ত থাকলেও দীর্ঘ ৫৪ বছর পর ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম স্যুয়ারেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে।
ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ৪০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য উৎপন্ন হয়। নালা-খাল হয়ে এসব বর্জ্য কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে গিয়ে পড়ে। জোয়ার-ভাটার টানে শেষ পর্যন্ত এ বর্জ্য বঙ্গোপসাগরেই মিশে যায়।
বর্তমানে প্রতিদিন ৫৩৯ ঘনমিটার মানববর্জ্য (ফিক্যাল স্লাজ) সেপটিক ট্যাংকে জমা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ১৫ ঘনমিটার এবং এনজিও ডিএসকের ব্যবস্থাপনায় ২০ ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করা হয়। বাকি অংশ নদী ও সাগরেই গিয়ে মিশে।
মাস্টারপ্ল্যানের সুপারিশ অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৩,৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথম ক্যাচমেন্টে কাজ শুরু হয়। নগরীর হালিশহরে ওয়াসার ১৬৩ একর জমিতে প্রথম স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। পরে এ খরচ বাড়িয়ে ৫,২১৯ কোটি টাকা করা হয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। তবে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে না; ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে।
প্রকল্পের আওতায় দৈনিক ১০ কোটি লিটার সক্ষমতার পয়ঃশোধনাগার, দৈনিক ৩০০ ঘনমিটার সক্ষমতার একটি ফিক্যাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ২০০ কিলোমিটার পয়ঃপাইপ লাইন নির্মাণ এবং ২৮ হাজার গৃহসংযোগ স্থাপনের কাজ চলছে।
দ্বিতীয় স্যুয়ারেজ প্রকল্প 'চট্টগ্রাম পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প (ক্যাচমেন্ট–২ ও ৪)' গত বছরের ২৫ নভেম্বর অনুমোদন পেয়েছে। নগরীর কালুরঘাট ও বাকলিয়া অঞ্চলের বাসিন্দাদের কেন্দ্রীয় স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার আওতায় আনতে ৫,১৫২.৫৬ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ৪,১৪৪ কোটি টাকা, সরকারি ঋণ ৫৮১.৫৬ কোটি টাকা, সরকারি অনুদান ৩৮৭.৭১ কোটি টাকা এবং ওয়াসার নিজস্ব অর্থ ৩৯ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির আওতায় কালুরঘাটের হামিদচর এলাকায় দৈনিক ৬ কোটি লিটার পয়ঃশোধনাগার, ১৫১ কিলোমিটার পাইপলাইন, ১৪ হাজার গৃহসংযোগ ও ১৪ হাজার ক্যাচপিট স্থাপন করা হবে।
এ দুটি ক্যাচমেন্টের জন্য ৭৪.১১ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নে ২,১৬৩.২৭ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ১,২৯৭.৯৬ কোটি টাকা এবং সরকারি অনুদান ৮৬৫.৩০ কোটি টাকা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নগরীর কাট্টলী এলাকার বাসিন্দাদের কেন্দ্রীয় স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার আওতায় আনতে ২,৭৯৭.২১ কোটি টাকার ক্যাচমেন্ট–৫ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এএফডি দেবে ১,৮৭২.১২ কোটি টাকা, সরকারি ঋণ ৯০৫.০৮ কোটি টাকা এবং ওয়াসার নিজস্ব তহবিল ২০ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পের অধীনে হালিশহরে প্রথম স্যুয়ারেজ প্রকল্পের জমিতেই দৈনিক ৫ কোটি লিটার সক্ষমতার পয়ঃশোধনাগার, ৯০ কিলোমিটার পাইপলাইন এবং ৮১ হাজার গৃহসংযোগ স্থাপন করা হবে।
এর বাইরে ৩,৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফতেহাবাদ ক্যাচমেন্ট (এসটিপি–৩) প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী দক্ষিণ কোরিয়ার ইডিসিএফ সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করেছে। এর আওতায় দৈনিক ৬ কোটি লিটার সক্ষমতার পয়ঃশোধনাগার, ১০০ ঘনমিটার সক্ষমতার ফিক্যাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ৫৮.৩০ কিলোমিটার পাইপলাইন ও সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
৯,৮৯৭.৫০ কোটি টাকার পতেঙ্গা ক্যাচমেন্ট (এসটিপি–৬) প্রকল্পটি সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে মারুবিনি কর্পোরেশন।
এই দুই প্রকল্প এখন পরিকল্পনা কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি কমিটির পর্যালোচনায় আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে অনুমোদন পাওয়া যেতে পারে।
রাজস্ব আদায় বড় চ্যালেঞ্জ
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, স্যুয়ারেজ সংক্রান্ত অনুমোদিত প্রকল্পগুলোতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৬,০১৬ কোটি টাকা এবং সরকারি ঋণ ৪,৫৬৩ কোটি টাকা। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোলে ২০৩৫ সালের আগেই সব প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব।
২০২৮ সালে প্রথম প্রকল্পের আওতায় স্যুয়ারেজ সেবা চালুর প্রত্যাশা রয়েছে। যেহেতু পানির বিলের ওপর ভিত্তি করে স্যুয়ারেজ বিল নির্ধারণ হবে, তাই প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কারণ ওয়াসার বিলিং ও তদারকি ব্যবস্থা এখনও দুর্বল। ফলে অ-রাজস্বভুক্ত পানির পরিমাণ প্রায় ২৫ শতাংশ। অভিযোগ আছে, এ পানি অবৈধভাবে বিক্রি হয় এবং আয় থেকে ওয়াসা বঞ্চিত হয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার বর্তমান সংযোগ ৯৬ হাজারের বেশি—যার ৯৩ শতাংশ আবাসিক, ৭ শতাংশ বাণিজ্যিক। প্রতিষ্ঠানটির সেবার আওতায় রয়েছেন প্রায় ৩২ লাখ মানুষ। তবে সংযোগ থাকা অন্তত ১০ শতাংশ গ্রাহক নিয়মিত পানি পান না।
ওয়াসার দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ৫৬ কোটি লিটার। এর মধ্যে ৬ কোটি লিটার শহরের বাইরে সরবরাহ করা হয়। সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমান চাহিদা ৫৬ কোটি লিটার। ২০৩২ সালে চাহিদা হবে ৭০ কোটি লিটার এবং ২০৪০ সালে দাঁড়াবে ১২২ কোটি লিটার।
ওয়াসার প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রুমন দে টিবিএসকে বলেন, "অ-রাজস্বভুক্ত হার আগের তুলনায় কমেছে। স্মার্ট মিটার বসানো হচ্ছে, মিটার রিডিং অ্যাপ চালু করা হচ্ছে। ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা ও তথ্যনির্ভর কার্যক্রম গড়ে তোলা হচ্ছে। গ্রাহকরা নিজেরাই মিটার রিডিং দিতে পারবেন—এমন আরেকটি অ্যাপ নিয়েও আলোচনা চলছে।"
ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের প্রতি জোর
জাইকার সহায়তায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে মিটার রিডিং অ্যাপ, ম্যানেজমেন্ট ড্যাশবোর্ড এবং নন-রেভিনিউ ওয়াটার মনিটরিং টুলসহ আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। বর্তমানে উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও রিপোর্টিংয়ের সব তথ্য এক্সেল-এ লিপিবদ্ধ হয় এবং বিলিং পদ্ধতি এখনো সম্পূর্ণ ম্যানুয়াল।
মিটার পরিদর্শক সংযোগগুলোর মিটার রিডিং নেন, এরপর আইটি বিভাগ বিল তৈরি করে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়। মিটার রিডিং থেকে বিল সংগ্রহ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় সময় লাগে ১২ সপ্তাহ। ম্যানুয়াল পদ্ধতির কারণে বিলিংয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ত্রুটি থাকে।
নতুন অ্যাপের মাধ্যমে বিলিং ব্যবস্থাকে অটোমেটেড করা হচ্ছে। অ্যাপে গ্রাহকের তথ্য ইনপুট, আগের বিলিং হিস্ট্রি বিবেচনা, পকেট প্রিন্টারের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক বিল প্রদান, মিটারের ছবি সংযুক্ত করা এবং জিপিএস ট্র্যাকিং ব্যবহারের ফলে জালিয়াতি কমবে। বর্তমানে তিন হাজার গ্রাহককে এই ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল আমিন টিবিএসকে বলেন, "প্রযুক্তি ও তথ্য ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে গ্রাহক পর্যায় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় পর্যন্ত সাপ্লাই চেইনের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে।"
প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, "জাইকার ট্রান্সফরমেশন কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে এবং স্মার্ট মিটার বসানো শুরু হলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।"
