চট্টগ্রাম ২: দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি, সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে নির্ভার জামায়াত
পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত লাগোয়া চট্টগ্রাম-০২ (ফটিকছড়ি) আসনটি দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের আধিপত্যে থাকলেও, দলটির অনুপস্থিতিতে এবার ভোটের মাঠের চিত্র ভিন্ন। আসন্ন নির্বাচনে আসনটি নিজেদের ঘরে তুলতে মরিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে ভোটের লড়াইয়ে নামার আগেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থীর দ্বন্দ্বে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে বিএনপি। অন্যদিকে, একক প্রার্থী ও সুসংহত সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে প্রচারণায় এগিয়ে রয়েছে জামায়াত।
প্রার্থী চিত্র ও অন্যান্য দল
এই আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন উত্তর জেলা শাখার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার আলমগীর। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সেক্রেটারি নুরুল আমিন।
অন্যান্য দলের মধ্যে গণসংহতি আন্দোলন থেকে মিজানুর রহীম চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে জুলফিকার আলী, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট থেকে আবদুল হামিদ এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টির চেয়ারম্যান সাইফুদ্দিন আহমদ মাইজভাণ্ডারী নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একরামুল হক মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেও দলটি এখনো চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়নি।
বিএনপিতে বিভক্তি ও ক্ষোভ
ফটিকছড়ি আসনটি একসময় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মাধ্যমে দলের দখলে এসেছিল। তবে গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের দুটিতে অংশ না নেওয়ায় এবার দলের ভেতর মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রার্থী সরওয়ার আলমগীর ছাড়াও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, সাবেক উপজেলা আহ্বায়ক সালাউদ্দিন আহমেদ, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মো. আজিম উল্লাহ বাহার, বিএনপিপন্থী চিকিৎসক পেশীজীবী নেতা ডা. খুরশীদ জামিল ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়জী মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। মূলত চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয় বিএনপি।
দলীয় প্রার্থী হিসেবে সরওয়ার আলমগীরের নাম ঘোষণার পর থেকেই মাঠে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে আজিম উল্লাহ বাহারের অনুসারীরা প্রকাশ্যে মশাল মিছিলও করেছেন।
তবে বিএনপির বিভাজন ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হলেও, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই দূরত্ব কমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) মাহবুবের রহমান শামীম।
এ বিষয়ে বিএনপির প্রার্থী সরওয়ার আলমগীর বলেন, 'দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকে সব মনোনয়ন প্রত্যাশী ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মশাল মিছিলটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যা বাইরে থেকে লোক এনে করা হয়েছে। দলে কোনো বিভাজন নেই, সবাই একসঙ্গেই আছি।'
অন্যদিকে, বিক্ষুব্ধ অংশের নেতা ও উপজেলা আহ্বায়ক মো. আজিম উল্লাহ বাহার বলেন, 'আমি ১৮টি ইউনিয়নে সম্মেলন করে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। ২০১৮ সালেও দলীয় প্রার্থী ছিলাম। দল নতুন প্রার্থী ঘোষণা করায় নেতাকর্মীরা আবেগী হয়ে প্রতিবাদ করেছে। তবে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে আমার কোনো বক্তব্য নেই।'
জামায়াতের কৌশল ও অবস্থান
বিএনপির বিভক্তির বিপরীতে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে জামায়াত। গত এক বছর ধরে প্রচারণায় সক্রিয় দলটির প্রার্থী নুরুল আমিন। ২০০৮ সালে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে তার নাম আলোচনায় থাকলেও শেষ মুহূর্তে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ছাড় দেওয়া হয়।
দলীয় কোন্দল না থাকায় জামায়াতের নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে মাঠে কাজ করছেন। দলটির প্রার্থী নুরুল আমিন বলেন, 'আমরা অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষ চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও দুঃশাসন থেকে মুক্তি চায়। এসব বিবেচনায় মানুষের পছন্দের জায়গায় রয়েছে জামায়াত।'
ফ্যাক্টর 'হেফাজতে ইসলাম'
কওমি ভাবধারার অন্যতম কেন্দ্র হাটহাজারী হলেও হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত আমীর শাহ আহমদ শফী ও বর্তমান আমীর মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর প্রভাব ফটিকছড়িতে অত্যন্ত প্রবল। বাবুনগরীর মাদ্রাসা ও তাদের বিশাল ভোট ব্যাংক এখানে জয়-পরাজয়ের বড় নিয়ামক।
বিএনপি প্রার্থী সরওয়ার আলমগীর হেফাজতের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছেন এবং জামায়াতবিরোধী অবস্থানে ভূমিকা রাখায় তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
অন্যদিকে, হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতের আকীদাগত পার্থক্যকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে জামায়াত প্রার্থী নুরুল আমিন তা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, 'হেফাজতের আমিরের সঙ্গে আমার শ্রদ্ধার সম্পর্ক। আকীদাগত কিছু পার্থক্য থাকলেও ভোটের মাঠে এর প্রভাব পড়বে না। মামুনুল হকসহ কওমি ভাবধারার অনেক নেতা আমাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় আছেন।'
অতীত নির্বাচনের পরিসংখ্যান
ফটিকছড়ি আসনে ১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন) ও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ এবং ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। ২০০৮ সালে বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ৫৭.৭২ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন, যেখানে আওয়ামী লীগের এটিএম পেয়ারুল ইসলাম পান ৪১.১৮ শতাংশ ভোট।
পরবর্তীতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের শরিক তরিকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খাদিজাতুল আনোয়ার নির্বাচিত হন।
