বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে জাতীয় লজিস্টিকস নীতি–২০২৫ প্রণয়ন করছে সরকার
২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক লজিস্টিকস হাবে রূপান্তরের লক্ষ্যে সরকার 'জাতীয় লজিস্টিকস নীতি–২০২৫' প্রণয়ন করেছে।
নীতি অনুমোদনের জন্য আজ বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে এটি উপস্থাপন করবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
গত বছরের এপ্রিলে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এ বিষয়ে একটি নীতিমালার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগের নীতিমালা বাতিল করে নতুন নীতি প্রণয়ন করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় প্রণীত খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, এই নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে বর্তমানে যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাচ্ছে, তা ধীরে ধীরে কমে আসবে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের দাম বাড়বে। এই অতিরিক্ত ব্যয় সামাল দেওয়া ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রপ্তানি খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নীতিটি সহায়তা করবে।
পরিবহন, গুদাম ও সংযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন
'লজিস্টিকস নীতি–২০২৫'-এর মূল লক্ষ্য হলো দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বল্প সময় ও ব্যয়ে পণ্য উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন, জাহাজীকরণ, ছাড়করণ ও বিতরণ সেবা নিশ্চিত করা। এজন্য সড়ক, রেল, সেতু, অভ্যন্তরীণ নৌপথ, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও টোল ব্যবস্থাসহ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, দেশের সব অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্পাঞ্চল, বিমান, নৌ, সমুদ্র ও স্থলবন্দর, ওয়্যারহাউজ, আইসিডি এবং এয়ার ফ্রেইট স্টেশনকে জাতীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। আন্তঃদেশীয় অর্থনৈতিক করিডোর নির্ধারণ করে তা সড়ক নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এছাড়া, সড়ক ব্যবহারকারীরা যেন যান চলাচলের অবস্থা সম্পর্কে আগেভাগেই তথ্য পান, সেই ব্যবস্থাও করা হবে।
রেলপথে পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা ও ভাড়ার হার বাড়ানোর কথাও উল্লেখ আছে খসড়ায়। এজন্য সব অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্পাঞ্চল, বন্দর ও ওয়্যারহাউজকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। রেলের গড় গতি বাড়াতে সব মিটারগেজ লাইন পর্যায়ক্রমে ব্রডগেজ ও ডুয়াল লাইনে রূপান্তর করা হবে।
নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, সারাবছর যেসব নৌরুটে নৌযান চলাচল সক্রিয় থাকে, সেসব রুট অনুযায়ী উপযোগী নৌযান তৈরি ও নিয়মিত ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি নৌবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। আকাশপথে পণ্য পরিবহন বাড়াতে বিশেষায়িত কার্গো সার্ভিস চালু এবং পৃথক এয়ার কার্গো টার্মিনাল স্থাপন করা হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১–২০৪১) অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশের মোট পণ্য পরিবহনের ৭৭ শতাংশ হয়েছিল সড়কপথে, ১৬ শতাংশ নৌপথে, ৬ শতাংশ রেলপথে এবং বাকি ১ শতাংশ অন্যান্য মাধ্যমে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি যেভাবে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে দেশে যাত্রী চলাচল, মালবাহী পরিবহন, পোর্ট কনটেইনার ট্রাফিক ও সমুদ্রগামী কার্গো পরিবহনের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই দেশের টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য লজিস্টিকস খাতের উন্নয়ন এখন অপরিহার্য।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ২০২০ সালে প্রকাশিত বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন 'মুভিং ফরওয়ার্ড: কানেক্টিভিটি অ্যান্ড লজিস্টিকস টু সাসটেইন বাংলাদেশ'স সাকসেস'–এ জানায়, বাংলাদেশে লজিস্টিকস সেবার ব্যয় খাতভেদে ৪.৫ শতাংশ থেকে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত, যা অন্যান্য বাণিজ্য সহযোগী ও প্রতিযোগী দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্দিষ্ট কিছু লজিস্টিকস খাতে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে জাতীয় রপ্তানি আয় ১৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এমনকি পণ্যমূল্যে পরিবহন বা লজিস্টিকস ব্যয় মাত্র ১ শতাংশ কমাতে পারলেও রপ্তানি চাহিদা ৭.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ অনেক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুবিধা হারাবে—যেমন শুল্ক ও কোটা রেয়াত, জিএসপি, রুলস অব অরিজিন এবং মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত নমনীয়তা। একইভাবে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অধীনে প্রাপ্ত স্পেশাল অ্যান্ড ডিফারেন্সিয়াল ট্রিটমেন্ট (এসঅ্যান্ডডিটি) সুবিধাও কমে যাবে।
উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ওপর নতুন নতুন বাধ্যবাধকতা আরোপিত হবে, যার ফলে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য ব্যয় বাড়বে। এতে গন্তব্য দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাবে। এ পরিস্থিতিতে লজিস্টিকস ব্যবস্থার দক্ষতা ও অবকাঠামো উন্নয়নই একমাত্র উপায়, যা বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে এবং রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে সহায়তা করবে।
দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর গঠিত প্রতিষ্ঠান বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) দীর্ঘদিন ধরে লজিস্টিকস খাত উন্নয়নে জোর দিয়ে আসছে।
প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা, পরামর্শ ও নীতিগত অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা এবং বেসরকারি খাতের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে।
বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশের লজিস্টিকস খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের প্রয়োজন, আর এই বিনিয়োগ আসতে হবে মূলত বেসরকারি খাত থেকে। এই নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার যে লজিস্টিকস খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং কোথায় কীভাবে কাজ হবে তার একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা করেছে—এটি বিনিয়োগকারীদের কাছে পরিষ্কার হবে। ফলে তারা এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।
তিনি আরও বলেন, "দেশের ৯টি মন্ত্রণালয় ও ১৯টি সরকারি সংস্থা সরাসরি লজিস্টিকস খাতের সঙ্গে যুক্ত। নীতিমালা অনুযায়ী এসব মন্ত্রণালয় ও সংস্থা নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা ঘোষণা করবে। বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান মাস্টারপ্ল্যানগুলোও এই কাঠামোর সঙ্গে একীভূত করা হবে।"
সব উদ্যোগ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা তদারকির জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অধীনে একটি বিশেষ সেল গঠন করা হবে। তিনি আরও বলেন, "সরকার এই পদক্ষেপগুলো নিলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে।"
