বিতর্কের জেরে দিল্লিতে নারী সাংবাদিকদের সামনের সারিতে বসিয়ে সংবাদ সম্মেলন তালেবান মন্ত্রীর

কথায় আছে—ছবি যেন হাজারো কথা বলে। সোমবার (১৩ অক্টোবর) ভারতের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত এমনই একটি ছবি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ছবিটিতে দেখা গেছে, আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সংবাদ সম্মেলনে সামনের সারিতে বসে আছেন ভারতীয় নারী সাংবাদিকেরা।
এই সংবাদ সম্মেলনটি ছিল গত ৪৮ ঘণ্টায় মুত্তাকির দ্বিতীয় মিডিয়া ব্রিফিং। শুক্রবার অনুষ্ঠিত প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ায় তীব্র সমালোচনার পর রোববার আফগান দূতাবাসে তড়িঘড়ি করে এই নতুন সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
রোববারের সংবাদ সম্মেলনে মুত্তাকি বলেন, 'আগেরবার নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ার ঘটনা মোটেও ইচ্ছাকৃত ছিল না, বরং প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণেই ওটা ঘটেছিল।'
তিনি বলেন, 'আসলে প্রেস কনফারেন্সটি হঠাৎ করেই নির্ধারিত হয়েছিল, এবং খুব সীমিত সংখ্যক সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমন্ত্রণ তালিকাটি নির্দিষ্টভাবে তৈরি হয়েছিল যে সব নাম আমাদের হাতের কাছে ছিল তার ভিত্তিতে, এর বাইরে আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না!'
তিনি আরও বলেন, 'হাতে আসলে সময় খুব কম ছিল, তাই মাত্র কয়েকজন সাংবাদিককেই আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হয়েছে। তবে কারও অধিকার – সে তিনি পুরুষ বা নারী যেই হোন -কখনোই অস্বীকার করা উচিত নয়।'
জাতিসংঘ আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিকে 'লিঙ্গভিত্তিক বর্ণবৈষম্য' বা 'জেন্ডার অ্যাপারথাইড' হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সেখানে নারীরা মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা নিতে পারেন না, পার্ক বা জিমে যেতে পারেন না, চাকরির সুযোগও সীমিত। পুরো দেহ ঢেকে রাখার পোশাক পরা বাধ্যতামূলক, এমনকি একা ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
২০২১ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই তালেবান সরকার বলছে, তারা আফগান সংস্কৃতি ও শরিয়াহ অনুযায়ী নারীদের অধিকার 'সম্মান' করে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকেরা মনে করেন, নারীদের ওপর দমননীতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার মুত্তাকি উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় অংশ নিতে ভারতে আসেন। রাশিয়ার পর ভারতই এমন একটি দেশ, যারা তালেবান সরকারের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ রাখছে। যদিও দিল্লি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, তবু কাবুলে ভারতের একটি ক্ষুদ্র কূটনৈতিক মিশন ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালু আছে।
শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকের পর মুত্তাকি জানান, ভারত কাবুলে বন্ধ থাকা দূতাবাসটি পুনরায় চালু করবে। কিন্তু সেদিন বিকেলে আফগান দূতাবাসে তার সংবাদ সম্মেলনে ১৬ জন পুরুষ সাংবাদিককে ঢুকতে দেওয়া হলেও নারী সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি।
তালেবান সরকারের এক সূত্র স্বীকার করে জানিয়েছিল, 'নারী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণই জানানো হয়নি।'
তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর কোনো দায় নিতে রাজি হয়নি। তারা জানায়, ওই সংবাদ সম্মেলনে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিকদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার।
বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, 'এই বৈষম্যমূলক অনুষ্ঠান হতে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের সব নারীর কাছে বার্তা দিয়েছেন—তোমরা এতটাই দুর্বল যে নিজেদের অধিকার রক্ষায়ও দাঁড়াতে পারো না।'
ভারতের এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান উইমেন্স প্রেস কর্পস এবং নেটওয়ার্ক অব উইমেন ইন মিডিয়া, ইন্ডিয়া (এনডব্লিউএমআই)—সবাই একযোগে এই বৈষম্যমূলক আচরণের নিন্দা জানিয়েছে।
গিল্ডের বিবৃতিতে বলা হয়, 'ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী দূতাবাসের কিছু কূটনৈতিক সুরক্ষা থাকতে পারে, কিন্তু ভারতীয় মাটিতে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়ার মতো লজ্জাজনক লিঙ্গবৈষম্য কোনোভাবেই ন্যায্য হতে পারে না।'
এনডব্লিউএমআই তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করে, 'নারী সাংবাদিকদের কাজের ও জীবিকার অধিকার রক্ষা করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই ঘটনায় তারা যে নিরব ছিল, তা অত্যন্ত হতাশাজনক।'
এমনকি সংস্থাটি পুরুষ সাংবাদিকদেরও সমালোচনা করে জানায়, 'যখন এমন বৈষম্য ঘটে, তখন নীরবতা মানে সেই অন্যায়ের অংশীদার হওয়া।'
বিতর্কের পর রোববার তালেবান পক্ষ থেকে নতুন করে আমন্ত্রণ পাঠানো হয় এবং জানানো হয়, এবার 'সব সাংবাদিকের জন্য উন্মুক্ত' সম্মেলন হবে। যদিও সরকারি ভাবে নিশ্চিত করা হয়নি, তবু ধারণা করা হচ্ছে—ভারত সরকারের চাপেই এই দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকেরা কঠিন প্রশ্ন তুলেছিলেন নারীদের অধিকার ও শিক্ষার বিষয়ে। জবাবে মুত্তাকি বলেন, 'আমাদের দেশে প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে, যার মধ্যে ২৮ লাখের বেশি নারী ও মেয়ে। মাদরাসায়ও স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ আছে। কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবে আমরা কখনও বলিনি নারীদের শিক্ষা শরিয়াহ অনুযায়ী হারাম; শুধু সাময়িকভাবে স্থগিত।'
তবে উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকে তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হননি। তারা মনে করিয়ে দেন, ২০২১ সালের পর থেকে ১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ এবং নারীদের জন্য চাকরির সুযোগও প্রায় নেই বললেই চলে। সম্প্রতি নারীদের লেখা বইও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যদিও মুত্তাকির বক্তব্য অনেককে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তবু নারী সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজনকে অনেকেই একধরনের অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন।