হিমায়িত মাছ ও চিংড়ি রপ্তানিতে ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, শীর্ষ গন্তব্য ভারত ও চীন

টানা দুই বছরের পতনের পর গত অর্থবছরে বাংলাদেশের হিমায়িত মাছ রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। উন্নত কমপ্লায়েন্স ও মান নিয়ন্ত্রণ জোরদারের ফলে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে হিমায়িত মাছ ও চিংড়ি রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩৮৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের ৩২৫ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ভারত ও চীনের চাহিদা বৃদ্ধি এ খাতের পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রেখেছে, যা বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাতে নতুন করে আস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
টানা চার বছরের মধ্যে এবারই হিমায়িত মাছ রপ্তানি খাত সবচেয়ে শক্তিশালীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে; যদিও আলোচ্য অর্থবছরে বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ আহরণ ২১ শতাংশ কমেছে এবং চিংড়ি চাষেও রয়ে গেছে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তারিকুল ইসলাম জহির বলেন, রপ্তানিকারকেরা নতুন কমপ্লায়েন্স বা অনুবর্তিতা শর্তের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিয়েছেন।
তিনি বলেন, "ট্রেসেবিলিটি বা উৎস শনাক্তকরণ, মান নিয়ন্ত্রণ ও রোগব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার উন্নতি এখন ফল দিচ্ছে।"
তবে তিনি জানান, অনুকূল আবহাওয়ার অভাব, নদী-খালের পলি জমে যাওয়া এবং চিংড়ি চাষে প্রয়োজনীয় লবণাক্ত পানি ব্যবহারে পরিবেশবাদীদের আপত্তির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিংড়ি উৎপাদন কমে গেছে।
তারিকুল ইসলাম জহির বলেন, "উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিকারকেরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। এর সঙ্গে ব্যাংক ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, যা এ খাতের প্রবৃদ্ধিকে আরও মন্থর করছে।"
চিংড়িই ঘুরে দাঁড়ানোর মূল চালিকা শক্তি
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, মাছ রপ্তানি খাতের আয়ের প্রধান অংশ এখনো চিংড়ির দখলে।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ২৩ হাজার ২৩৮ টন হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে ২৯৬ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় মূল্যে ১৯ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং পরিমাণে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
প্রতি কিলোগ্রাম চিংড়ির গড় রপ্তানি মূল্য সামান্য কমে ১২ দশমিক ৯৮ ডলার থেকে ১২ দশমিক ৭৫ ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা ভিয়েতনাম ও ভারতের প্রতিযোগিতার চাপকে নির্দেশ করে।
অন্যদিকে, হিমায়িত মাছের রপ্তানি মূল্য ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়ে ৯২ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও রপ্তানির পরিমাণ ১০ দশমিক ৭ শতাংশ কমে ৭ হাজার ৯৫১ টনে নেমে এসেছে।
প্রতি কিলোগ্রাম মাছের গড় মূল্য ৮ দশমিক ৬৯ ডলার থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ৬২ ডলারে উঠেছে, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে—ক্রেতারা উচ্চমূল্যের প্রজাতি বেছে নিচ্ছেন বা বৈশ্বিক মৎস্যবাজারে মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ছে।
ঝড়ঝাপটার পর ঘুরে দাঁড়ানো
দীর্ঘ মন্দার পর আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মৎস্য রপ্তানি খাত। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, মহামারিজনিত বিপর্যয় এবং 'আর্লি মরটালিটি সিনড্রোম'-এর মতো রোগে খুলনা ও সাতক্ষীরার চিংড়ি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি কমে যায় ২০ শতাংশের বেশি, পরের বছর আবারও প্রায় ১০ শতাংশ হ্রাস পায়।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মানদণ্ডে আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কোল্ড-চেইন ব্যবস্থায় বিনিয়োগ, টাকার মান কমে যাওয়ায় রপ্তানি প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, চীনের চাহিদা বৃদ্ধি এবং ইউরোপের রেস্তোরাঁ খাতে চাহিদা ফেরার ফলে এ খাত আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বদলে যাচ্ছে বৈশ্বিক চাহিদার ধারা
চিংড়ি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজারে পরিণত হয়েছে চীন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশটি বাংলাদেশ থেকে ৫৬ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ডলারের চিংড়ি আমদানি করেছে। অন্যদিকে, নেদারল্যান্ডস আমদানি করেছে ৪৭ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্য ৪৪ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলারের চিংড়ি আমদানি করেছে। বাংলাদেশের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি আয়ের অর্ধেকেরও বেশি আসে ইউরোপীয় এই দেশগুলো থেকে।
হিমায়িত মাছের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান শীর্ষে। দেশটি ৬২ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলারের মাছ আমদানি করেছে, এর পরেই রয়েছে চীন ৫৯ দশমিক ০৩ মিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্য ৫২ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন ডলারের মাছ আমদানি করেছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের খাতগুলোর মধ্যে মৎস্য অন্যতম। এ খাতের ওপর খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের মতো উপকূলীয় অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা নির্ভর করে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ খাতের পুনরুদ্ধারের ফলে উপকূলীয় অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি আসবে বলে আশা করা হচ্ছে—বিশেষত খামার বন্ধ হওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও রপ্তানিতে ধীরগতির প্রভাব কাটাতে।
তবে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির পরও নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। চিংড়ি খামারগুলোকে উচ্চ উৎপাদন ব্যয়, পানিদূষণ, মানসম্মত ব্রুডস্টকের অভাব, রোগব্যাধি এবং দুর্বল জৈব-নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতো সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চাষযোগ্য এলাকা কমে আসছে, ফলে অনেক খামারি এখন মিক্সড অ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছেন। অন্যদিকে, রপ্তানি বাজারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যান্টিবায়োটিক অবশিষ্টাংশ ও টেকসই উৎপাদন মানদণ্ডে কঠোর নিয়মের কারণে কমপ্লায়েন্স ব্যয়ও বাড়ছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক রপ্তানিকারক দোদুল কুমার দত্ত বলেন, "সঠিক ট্রেসেবিলিটি ও খামার থেকে কারখানা পর্যায় পর্যন্ত স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে আমরা প্রিমিয়াম বাজার হারানোর ঝুঁকিতে পড়ব।"
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১১০টি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা থাকলেও বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে মাত্র ৩০ থেকে ৪০টি, যার মধ্যে পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে মাত্র ১০টি। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, খামার পর্যায়ে উৎপাদন বাড়াতে পারলেই অচল কারখানাগুলো আবার চালু করা সম্ভব হবে।
দোদুল কুমার দত্ত বলেন, "সংখ্যায় ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত মিলছে ঠিকই, তবে উন্নত হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা, রোগ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ এবং কোল্ড-চেইন অবকাঠামোতে বিনিয়োগ নিয়ে আসার মতো সংস্কারগুলো আগে করতে হবে।"