ঐতিহাসিক ভারত সফরে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী

দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ছয় দিনের সফরে ভারতে এসেছেন। ২০২১ সালে তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর এটিই কোনো শীর্ষ তালেবান নেতার প্রথম ভারত সফর।
গেল বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে পৌঁছান আমির খান মুত্তাকি। সফরকালে তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর এবং অন্যান্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল আমির খান মুত্তাকিকে 'উষ্ণ অভ্যর্থনা' জানিয়ে এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন, 'দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক বিষয়গুলো নিয়ে তার সঙ্গে একটি গঠনমূলক আলোচনা হবে বলে আমরা আশাবাদী।'
অন্যদিকে, তালেবানের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন যে, মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে 'বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিষয় এবং আফগানিস্তান ও এই অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের' জন্য বৈঠক করবেন।
এ ছাড়া তার তাজমহল এবং একটি ঐতিহাসিক ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের কথা রয়েছে।
জাতিসংঘের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় থাকা আমির খান মুত্তাকিকে এই সফরের জন্য সাময়িক ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তিনি রাশিয়া থেকে দিল্লিতে এসেছেন। রাশিয়া এখন পর্যন্ত একমাত্র দেশ যারা তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
যদিও এই সফরটি এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কে তীব্র অবনতি ঘটেছে। ঐতিহাসিকভাবে তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান এই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইসলামাবাদ, দিল্লি বা তালেবান—কেউই ধারণা করতে পারেনি যে ক্ষমতা দখলের এত অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক এতটা খারাপ হবে, আর অন্যদিকে ভারত কাবুলের নতুন সরকারের সঙ্গে একটি বহুমাত্রিক সম্পর্ক স্থাপন করবে।
আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের খেলায় ভারত ও পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই একে অপরের প্রতিপক্ষ। ১৯৯৪ সালে তালেবানের উত্থানের পর থেকেই ভারতের সামরিক ও রাজনৈতিক মহল এই সংগঠনটিকে পাকিস্তানের ছায়া সংগঠন বা 'প্রক্সি' হিসেবেই দেখে এসেছে। তাদের ধারণা ছিল, আফগানিস্তান থেকে ভারতকে বিতাড়িত করাই এর মূল লক্ষ্য।
কিন্তু তালেবান দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, তালেবান সরকার পাকিস্তানি তালেবানকে (টিটিপি) আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলা চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। এই নিয়ে এতটাই তিক্ততা তৈরি হয়েছে যে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে আফগানিস্তানকে 'শত্রু দেশ' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
মাত্র চার বছরের কিছু বেশি সময় আগে, এসবকিছুই অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুল দখল করার সঙ্গে সঙ্গে ভারত আফগানিস্তানে তার দূতাবাস এবং চারটি কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়। এমনকি নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে, ভারত হাজার হাজার আফগানকে ইতিমধ্যে দেওয়া প্রায় সমস্ত ভিসা বাতিল করে দেয়।
কিন্তু এক বছরের মধ্যেই ভারত তার কূটনৈতিক উপস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। ২০২২ সালের জুনে আফগানিস্তানে একটি 'কারিগরি দল' পাঠানো হয়, যাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল মানবিক সহায়তা বিতরণ তদারকি করা।
এরপর দিল্লি প্রভাবশালী তালেবান ব্যক্তিত্ব, সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসা দেওয়া শুরু করে। গত বছরের নভেম্বরে, ভারত তালেবানকে দিল্লিতে একজন দূত নিয়োগ এবং মুম্বাই ও হায়দ্রাবাদে কনস্যুলেট খোলার অনুমতি দেয়।
তবে, তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের পেছনে মূল কারণ হলো দেশটির নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ। দিল্লির সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ নিরাপত্তা, বিশেষ করে ইসলামিক স্টেট (আইএস), আল-কায়েদা এবং ভারতকেন্দ্রিক অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপরতা।
তালেবান দিল্লিকে আশ্বস্ত করেছে যে, ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।
তা ছাড়া, এই অঞ্চলে চীন ও পাকিস্তানের প্রভাব মোকাবিলা করে ইরান এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ বাড়াতেও তালেবানের সঙ্গে সুসম্পর্ক দিল্লির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে সম্পর্ক গভীরতর হলেও, উভয় পক্ষই বেশ সতর্ক। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে তাদের সম্পর্কটি এখনো কৌশলগত পর্যায়েই রয়ে গেছে।