তালেবান ইন্টারনেট বন্ধ করায় ‘শেষ ভরসাটুকুও’ হারালেন আফগান নারীরা
আফগানিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশের সময় ফাহিমা নূরির (ছদ্মনাম) অনেক বড় বড় স্বপ্ন ছিল। তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, মিডওয়াইফারি প্রোগ্রামে স্নাতক করেছেন এবং মানসিক স্বাস্থ্য ক্লিনিকে কাজও করেছেন।
কিন্তু ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর সব কিছুই শেষ হয়ে যায়। তারা ১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়, নারীদের চাকরির সুযোগ কঠোরভাবে সীমিত করে এবং সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারীদের লেখা বই সরিয়ে দেয়। খবর বিবিসি'র
ফাহিমার জন্য ইন্টারনেটই ছিল বাইরে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম।
তিনি বলেন, 'আমি সম্প্রতি একটি অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি এবং আশা করছিলাম পড়াশোনা শেষ করে অনলাইন চাকরি পাব।'
মঙ্গলবার তালেবান সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ ঘোষণা করার মধ্যদিয়ে তার সেই আশাটুকুও শেষ হয়ে যায়।
ফাহিমা বলেন, 'আমাদের শেষ আশা ছিল অনলাইন শিক্ষা। এখন সেটাও নিঃশেষ হয়ে গেছে।'
নিরাপত্তার স্বার্থে ফাহিমা এবং এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা সবার ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
'আমরা সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছি'
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তালেবান সরকার কয়েকটি প্রদেশে ফাইবার-অপটিক ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা শুরু করে।
তাদের দাবি, এটি অশ্লীলতা রোধের একটি প্রচেষ্টা।
অনেকে আশঙ্কা করছিলেন যে এটি সম্পূর্ণ ইন্টারনেট বন্ধের প্রথম ধাপ হতে পারে। মঙ্গলবার সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়।
ইন্টারনেট পর্যবেক্ষণ সংস্থা নেটব্লকস জানায়, দেশটি বর্তমানে 'সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট'-এর মুখোমুখি, যা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেবা কার্যক্রমকে অচল করে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, তারা রাজধানী কাবুলের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়েছে। পুরো আফগানিস্তানে মোবাইল ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইট টিভি পরিষেবায় গুরুতর বিঘ্ন হয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাবুল বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট চলাচলও ব্যাহত হয়েছে।
সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধের আগে বিবিসি আফগানিস্তানের কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়। ইন্টারনেট বিঘ্নের কারণে কতটা সমস্যার মুখে পড়েছেন তা জানান তারা।
উত্তর প্রদেশ তাহকরের বাসিন্দা শাকিবা বলেন, 'এর আগে আমি মিডওয়াইফারি নিয়ে পড়তাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নারীদের জন্য সেই প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে গেছে… আমাদের একমাত্র আশা ছিল ইন্টারনেট এবং অনলাইন শিক্ষা।'
ফাহিমার অবস্থাও একই রকম। তিনি 'হতাশ' হয়ে পড়েছেন।
তিনি বলেন, 'আমার দুই বোন এবং আমি অনলাইনে পড়াশোনা করতাম। আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংবাদ ও প্রযুক্তির বিষয়ে আপডেট থাকতাম, কিন্তু এখন আমরা নতুন কিছু শিখতে পারি না। আমরা স্বপ্ন দেখতাম পড়াশোনা শেষ করে বাবাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করব, কিন্তু এখন… আমরা সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছি।'
২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকে তালেবান ইসলামিক শরিয়াহ আইন অনুযায়ী বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
এই মাসের শুরুতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় নারীদের লেখা বই সরিয়ে দেয়। নতুন নিষেধাজ্ঞায় মানবাধিকার ও যৌন হয়রানির শিক্ষা দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারীদের লেখা প্রায় ১৪০টি বই 'শরিয়াহ ও তালেবান নীতিবিরোধী' ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে 'সেফটি ইন দ্য কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি' বইটিও রয়েছে।
তালেবান সরকার দাবি করেছে, তারা আফগান সংস্কৃতি ও ইসলামী আইন অনুযায়ী নারীদের অধিকার রক্ষা করে।
কিন্তু শুধুমাত্র নারী শিক্ষার্থীরাই প্রভাবিত হননি।
অনলাইন শিক্ষা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা জাবি নামের এক শিক্ষকও সমস্যার মুখে পড়েছে।
জাবি বলেন, 'আমি আগে পাকিস্তানে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি, কিন্তু আফগানিস্তানে ফিরে এসে কোনো সুযোগ পাইনি। আমি ইংরেজি শিক্ষাকেন্দ্র খুলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধিনিষেধ আরোপ করার পর আমাকে অনলাইনে কাজ করতে হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'দুই দিন আগে আমার প্রায় ৪৫ জন ছাত্র পরীক্ষা চলাকালীন ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। তারা সারামাস প্রস্তুতি নিয়েছিল, কিন্তু পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেলো না। এটি তাদের জন্য এবং শিক্ষক হিসেবে আমার জন্যও ভীষণ কষ্টের।'
ইন্টারনেট পুনরায় চালু না হলে জাবি দেশের বাইরে চলে যেতে চান, কারণ দেশে তার জীবিকা নির্বাহের অন্য কোনো উপায় নেই।
তালেবান সরকার এখনও ইন্টারনেট বন্ধের কোনো আনুষ্ঠানিক কারণ জানায়নি।
এক সাক্ষাৎকারে তাহকরের মানি চেঞ্জার আনাস বলেন, 'আমাদের ব্যবসা প্রায় ৯০% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল আমার ভাই, যিনি আমার ব্যবসায়িক অংশীদার, ক্লায়েন্টকে ই-মেইল পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারলেন না।'
তিনি বলেন, 'কিন্তু আমার মূল উদ্বেগ আমার তিনটি কন্যা। তারা সবাই অনলাইন ক্লাস করত। তাদের পড়াশোনার শেষ সুযোগও এখন শেষ। তাদের অসহায় মুখ দেখাটা আমার জন্য সবচেয়ে কষ্টের। শুধু আল্লাহ জানেন তাদের এবং আমার কি হবে।'
