গাজা যুদ্ধবিরতি: উপত্যকার কিছু এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, উত্তরাঞ্চলে ফিরছেন ফিলিস্তিনিরা

শুক্রবার সকাল থেকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গাজা উপত্যকার কিছু এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইসরায়েলি বাহিনী জানিয়েছে, তারা উপত্যকার ভেতরে 'সম্মত স্থানে' অবস্থান করছে। তবে এখনও গাজার অর্ধেক অংশ তাদের দখলে রয়েছে। খবর বিবিসি'র।
প্রকাশিত ফুটেজে দেখা গেছে, হাজারো ফিলিস্তিনি গাজার উত্তরাঞ্চলের দিকে ফিরে যাচ্ছেন—যে অঞ্চলটি কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছিল। যুদ্ধবিরতি বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত চুক্তির প্রথম ধাপ অনুমোদনের পর কার্যকর হয়েছে। চুক্তির পরবর্তী ধাপগুলো এখনও আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, হামাসকে সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার মধ্যে সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে। এদের মধ্যে প্রায় ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং আরও ২৮ জনের মৃতদেহ ফেরত দেওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলকে প্রায় ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। এর মধ্যে ১০০ জনকে পশ্চিম তীরে, পাঁচজনকে পূর্ব জেরুসালেমে ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া গাজা থেকে আরও ১,৭০০ ফিলিস্তিনি মুক্তি পাবেন।
চুক্তি অনুযায়ী, গাজার সাধারণ মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো কোনো বাধা ছাড়া উপত্যকায় প্রবেশ করতে পারবে। দুই বছরের যুদ্ধের মধ্যে বহুবার বাস্তুচ্যুত হওয়া গাজার বাসিন্দারা এই সহায়তার অপেক্ষায় ছিলেন। শুক্রবার থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করার আশা করা হচ্ছে। তবে কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। যুদ্ধবিরতি শুরুর পর অতিরিক্ত ত্রাণ পৌঁছেছে কি না, সেটিও নিশ্চিত নয়।

জাতিসংঘ-সমর্থিত বিশেষজ্ঞরা গত আগস্টে প্রথমবারের মতো গাজার কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেছিলেন। তাদের মতে, পাঁচ লাখের বেশি মানুষ সেখানে 'ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও মৃত্যুর' মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি। ইসরায়েল বারবার দাবি করে আসছে, গাজার মধ্যে দুর্ভিক্ষ হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রায় ২০০ মার্কিন সেনাকে ইসরায়েলে পাঠানো হবে, যাতে তারা গাজায় যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে সহায়তা করতে পারে।
গাজার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সেনারা গাজা শহরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে সরে পূর্বদিকে অবস্থান নিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলেও খান ইউনুস এলাকা থেকে কিছু সেনা পিছু হটেছে। সামাজিক মাধ্যমে এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, দুপুর ১২টা থেকে সেনারা 'নতুন মোতায়েন রেখা' বরাবর অবস্থান নিয়েছে। তারা জানিয়েছেন, দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের সেনারা এখনও এলাকায় মোতায়েন রয়েছেন এবং যেকোনো হুমকি প্রতিরোধে কাজ চালিয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ জানিয়েছেন, আইডিএফ সেনারা 'প্রথম ধাপের প্রত্যাহার সম্পন্ন করেছে'। তিনি এটিকে 'ইয়েলো লাইন' হিসেবে উল্লেখ করেছেন—যা হোয়াইট হাউসের মানচিত্রে দেখানো হয়েছিল। এই ধাপে সেনারা ওই রেখা পর্যন্ত সরে গিয়ে গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখবে। জিম্মিদের মুক্তির জন্য ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা শুরু হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, 'সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হচ্ছে।' তিনি জানিয়েছেন, সেনারা এখনও সব দিক থেকে হামাসকে ঘিরে রেখেছে। ট্রাম্পের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপে রয়েছে হামাসকে নিরস্ত্র করা এবং গাজাকে সামরিক শক্তিমুক্ত করা। তবে হামাস এখনও কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি।

শুক্রবার সকালে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সময় নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ভোররাত পর্যন্ত গাজায় বিমান হামলা চলেছে। হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭ জন নিহত হয়েছেন। আইডিএফ জানিয়েছে, তারা নতুন মোতায়েন রেখা থেকে 'যেকোনো হুমকি প্রতিরোধে' অভিযান চালাবে এবং সাধারণ মানুষকে সামরিক এলাকায় প্রবেশ না করার আহ্বান জানিয়েছে।
যেসব এলাকায় সেনারা সরে গেছে, সেখানে হামাসের নিরাপত্তা বাহিনী রাস্তায় টহল দিচ্ছে। তাদের মাথায় হামাসের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থার লোগোযুক্ত টুপি ছিল। শুক্রবার হামাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা গাজার ওপর কোনো 'বিদেশি অভিভাবকত্ব' মানে না। গাজার শাসন সম্পূর্ণভাবে ফিলিস্তিনিদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
অন্যদিকে ট্রাম্পের ২০ দফার শান্তি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসনে হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না। সেখানে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন গঠন করা হবে, যা পরিচালনা করবেন ফিলিস্তিনি প্রযুক্তিবিদদের একটি দল। এই প্রশাসন তত্ত্বাবধান করবে 'বোর্ড অব পিস', যার প্রধান ও চেয়ারম্যান থাকবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে যুক্ত থাকবেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও। পরবর্তীতে গাজার প্রশাসনিক দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) কাছে।
হামাস আরও আশা প্রকাশ করেছে, পুনর্গঠন, পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রে গাজা যেন 'আরব দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ থেকে উপকৃত হয়'।
সেনারা আংশিকভাবে সরে যাওয়ার পর গাজার উপকূলীয় সড়ক ধরে হাজারো ফিলিস্তিনিকে উত্তর দিকে যাত্রা করতে দেখা গেছে। অনেকেই পিঠে নিজেদের অবশিষ্ট সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে পায়ে হেঁটে ২০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত সরু রাস্তাগুলো ধরে কেউ কেউ ফিলিস্তিনি পতাকা উড়িয়েছেন, কেউ আবার বিজয়ের চিহ্ন দেখিয়েছেন। তবে অনেকের চেহারায় ফুটে উঠেছে ক্লান্তি, অপুষ্টি আর দীর্ঘ কষ্টের ছাপ।
'রাস্তা অনেক লম্বা, পথে খাবার বা পানি নেই,' বলেছেন গাজার স্কুলশিক্ষক আলা সালেহ। স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে নিয়ে তিনি খান ইউনুসে পালিয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'আমি পরিবারকে রেখে একাই উত্তরের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি। চারপাশে হাজারো মানুষ কষ্ট করছে। একটি গাড়ি ভাড়া নিতে লাগে প্রায় ৪ হাজার শেকেল (প্রায় ১,২২৭ ডলার), যা বেশিরভাগ মানুষের সাধ্যের বাইরে।'
উত্তরাঞ্চলের জাবালিয়ায় বাড়ি ফেরার পথে ওয়ায়েল আল-নাজ্জার জানিয়েছেন, তিনি ছেলেকে নিয়ে রাত কাটিয়েছেন, যাত্রা শুরু করার সুযোগের অপেক্ষায়। তিনি বলেন, 'বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেলেও, শুধু ধ্বংসস্তূপই যদি থাকে, তবুও আমরা ফিরব। একটি তাঁবু ফেলব, নিজেদের মানুষের কাছে ফিরে যাব।'

রাস্তার অধিকাংশ মানুষই গাজা শহরের দিকে যাচ্ছেন—যার বড় অংশই এখন ধ্বংসস্তূপ। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা সিভিল ডিফেন্স সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাস্সাল জানিয়েছেন, শুক্রবার প্রায় দুই লাখ মানুষ উত্তরাঞ্চলে ফিরে গেছে।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, শেখ রাদওয়ান, সাবরা ও জয়তুন এলাকার প্রধান অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বহু বহুতল ভবন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। গাজার সিভিল ডিফেন্স সদস্যরা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে লাশ উদ্ধার করছেন। ত্রাণ সংস্থাগুলো সতর্ক করেছেন, খাবার, জ্বালানি ও বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ এখনও মারাত্মকভাবে সংকটাপন্ন।
ইউরি গোরেন নামের এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে নিহত ও নিখোঁজ হওয়া তার চাচাতো ভাই তল হাইমির মরদেহ ফেরানোর দাবিতে তিনি দুই বছর ধরে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা শুনে তিনি 'বড় একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন'।
তবে হামাস জানিয়েছে, সব মৃত জিম্মির মরদেহ কোথায় আছে তা তারা জানে না; যেটি ইউরির আনন্দ কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে। তিনি বলেন, '৪৮ জনের মরদেহ ফিরে না আসা পর্যন্ত এটা শেষ হবে না।'
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার মধ্য দিয়ে গাজায় যুদ্ধ শুরু হয়। তখন প্রায় ১,২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ১৮ হাজারের বেশি শিশু।
জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলকে গাজায় যুদ্ধ চলাকালে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। ইসরায়েল এই প্রতিবেদন সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, এটি 'বিকৃত ও মিথ্যা'।