গাজায় যুদ্ধবিরতির আসল বিজয়ী কাতার
গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি দ্বিতীয় সপ্তাহে পা দিতে না দিতেই আরও প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। কিন্তু, এরইমধ্যে ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতির মহলে শুরু হয়েছে তাদের চিরচেনা প্রিয় খেলা—"বিজয় ঘোষণা"।
এই যুদ্ধবিরতি করিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে শান্তিদূত ঘোষণা করেছেন; নেতানিয়াহু আবেগভরে ফিরিয়ে নিচ্ছেন হামাসের থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মিদের; আর হামাস নেতারা দোহা থেকে বলছেন, "প্রতিরোধের শক্তি বিজয়ী।" যেন মনে হচ্ছে, সবাই-ই জিতেছে।
কিন্তু এই "সবাই জয়ী"র গল্প এক মৌলিক প্রশ্নকে আড়াল করছে—মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আসল কৌশলগত সুবিধা কার হাতে গেছে? আবেগঘন পুনর্মিলন, প্রেসিডেন্টের ফটোসেশন আর সব পক্ষের প্রচারগর্জন সরিয়ে তাকালেই চোখে পড়বে ভিন্ন দৃশ্যপট।
এই পর্বের প্রকৃত বিজয়ী জেরুজালেমে নয়, গাজায় নয়, এমনকি ওয়াশিংটনেও নয়—বিজয়ীর অবস্থান দোহায়।
গাজার শান্তি আলোচনায় কাতার এক বিস্ময়কর কৌশলগত অর্জন দেখিয়েছে। বিপুল সম্পদশালী অথচ ক্ষুদ্র এই উপসাগরীয় দেশটি বহু বছর ধরে হামাস নেতৃত্বকে আশ্রয় দিয়েছে, বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ সহায়তা দিয়েছে এবং আল জাজিরার মাধ্যমে পুরো আরব দুনিয়ায় হামাসের বক্তব্য ছড়িয়ে দিয়েছে।
ফলে যেদিক থেকেই দেখুন না কেন, কাতার হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের এক মুখ্য পৃষ্ঠপোষক। তবু আশ্চর্যজনকভাবে, সাম্প্রতিক এই যুদ্ধের পর কাতারকে কোনো "বহিষ্কৃত বা অচ্ছুৎ রাষ্ট্র" হতে হয়নি, বরং হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের অবিচ্ছেদ্য মধ্যস্থতাকারী শক্তি।
বিষয়টি যতই অদ্ভুত মনে হোক, ট্রাম্পও যখন যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করতে চাইলেন, তখন প্রথমেই তিনি মিশর বা সৌদি আরবের দিকে তাকাননি। অথচ গাজার সীমান্তবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো মিত্র মিশর, আঞ্চলিক বৃহৎশক্তি সৌদি আরব তো আরও ঘনিষ্ঠ। এরপরঅ তিনি এই দু'দেশকেই পাশ কাটিয়ে প্রথমেই সাহায্য চেয়ে হাত বাড়ালেন কাতারের দিকে।
যে কাতার হামাস নেতাদের আরামদায়ক বাসস্থান দিয়েছে, যেখানে বসে বসে তারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনা ও উদযাপন করেছে, সেই দেশটিরই প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠলেন ওয়াশিংটনের কাছে অপরিহার্য মধ্যস্থতাকারী—যার ভূমিকা ছাড়া কোনো চুক্তিই সম্ভব ছিল না।
ফলাফল কাতারের জন্য অভূতপূর্ব। গাজা নিয়ে আঞ্চলিক সম্মেলন এখন কোথায় হচ্ছে? উত্তর- দোহায়। গাজার পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তার শর্ত কে ঠিক করছে? উত্তর হচ্ছে কাতার।
যে আরব নেতাকে ট্রাম্প কোনো চাপ দেননি উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করতে—তিনি কাতারের আমির। বিপরীতে, মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিকে ট্রাম্পের "গাজা রিভেরা" প্রস্তাব নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে অপমানিত হতে হয়েছে।
এমনকি গত সেপ্টেম্বর ইসরায়েল যখন দোহায় হামাসের অফিসে হামলার চেষ্টা করে পরে "ভুলবশত" হয়েছে বলে ক্ষমা চায়, তখন কাতারের "অস্পর্শ্য" মর্যাদা আরও পোক্ত হয়। ২০১৭ সালের উপসাগরীয় সংকটে যে আরব নেতারা কাতারকে বয়কট করেছিলেন, আজ তারাই দোহায় লাইন দিচ্ছেন। তাঁরাও বুঝতে শুরু করেছেন আসল প্রভাবটা কোথায় জমা হয়েছে।
এটাই প্রকৃত রিয়েলপলিটিক বা বাস্তববাদী কূটনীতি, যেখানে কাতার খেলেছে দক্ষতার সঙ্গে। হামাস ও যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও উপসাগরীয় প্রতিবেশী ইসরায়েল, মুসলিম ব্রাদারহুড ও বাস্তববাদী স্বৈরাচার—সবার সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে কাতার নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
এই কৌশল দেখায়, মধ্যপ্রাচ্যে "কারো বিশ্বস্ত মিত্র" হওয়ার চেয়ে "সব পক্ষের মধ্যস্থতাকারী" হওয়াই বেশি মূল্যবান। কাতার সেই বাজি ধরেছিল, আর এখন সেই বাজিতে জিতে এখন লাভ কুড়াচ্ছে।
নেতানিয়াহু হয়তো দাবি করতে পারেন, হামাসের ক্ষমতা দুর্বল হয়েছে এবং জিম্মিরা মুক্তি পেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। কিন্তু হামাসকে ধ্বংস করার তার লক্ষ্য স্পষ্টভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
বিভিন্ন রিপোর্টে নিশ্চিত হয়েছে, হামাস এখনও গাজার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। তারা ইসরায়েলি অভিযানের ধাক্কা সামলে "প্রতিরোধের বিজয়ী" হিসেবে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রেখেছে। অসম যুদ্ধের সংজ্ঞায়—পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্বলের টিকে থাকা মানেই বিজয়।
অন্যদিকে ইসরায়েল দিয়েছে ভয়াবহ মূল্য। শত শত সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে, তবুও কোনো নিশ্চিত ফল অর্জন করতে পারেনি। গাজায় গণহত্যার অভিযোগ ঘিরে তেল আবিবের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা আরও গভীর হচ্ছে, এমনকি ঐতিহ্যগত মিত্ররাও নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিচ্ছে।
যুদ্ধবিরতির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
গাজা যুদ্ধবিরতি অস্থির ও দুর্বল। যার নিয়মিত লঙ্ঘন ঘটছে, আর মূল নিরাপত্তা সমস্যা রয়ে গেছে আগের জায়গায়। ইসরায়েল চাইলে আবার অভিযান শুরু করতে পারে, কিন্তু তাতেও তার লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।
হামাসের জন্য টিকে থাকা মানেই প্রতিরোধের বৈধতা। গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, লাখো প্রাণ গেছে, তবুও তাদের রাজনৈতিক অবস্থান টলেনি। তারা ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিরস্ত্র হতে রাজি নয়, বরং গাজার অবশিষ্ট অংশে ক্ষমতা ধরে রেখেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য এই যুদ্ধবিরতি কূটনৈতিক সাফল্যের চেয়ে রাজনৈতিক নাটক। ইসরায়েলি জিম্মিরা ফিরছে—এই ছবিটিই তাকে "শান্তির স্থপতি" হিসেবে উপস্থাপন করছে। কিন্তু সমস্যার মূল কোথায় সমাধান হলো? হামাস তো টিকে আছে, গাজার ভবিষ্যৎ-ও অনির্দিষ্ট।
যুদ্ধবিরতির এই "শান্তি পরিকল্পনা" আসলে একধরনের সংকট ব্যবস্থাপনা—স্থায়ী সমাধান নয়। এটি যতদিন স্থায়ী হয়, ততদিনই টিকে থাকবে।
আসল ট্র্যাজেডি ফিলিস্তিনিদের
গাজা যুদ্ধে হাজারো প্রাণহানি, অসংখ্য আহত, অবকাঠামো নিশ্চিহ্ন হয়েছে—তবুও আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মর্যাদার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে ফিলিস্তিনি জনগণের। পশ্চিম তীর-ভিত্তিক ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বহুদিন ধরেই তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক; অন্যদিকে ইসরায়েলি নিপীড়নের বিরুদ্ধে হামাসের "প্রতিরোধ" এনেছে ধ্বংস, মুক্তি নয়। বিশ্বও শিগগিরই অন্য সংকটে মনোযোগ দেবে। তখন কেইবা মনে রাখবে, হতভাগ্য ফিলিস্তিনিদের কথা। তেমনটাই যুগে যুগে তাদের সাথে হয়ে আসছে।
ফলে যুদ্ধ পরবর্তী গাজার শাসন ও পুনর্গঠনের প্রশ্নের এখনো নেই কোনো উত্ত—বরং বর্তমান বাস্তবতায় উত্তর দেওয়াই যাকে বলে অসম্ভব।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
অসলো চুক্তি, ২০০৫ সালের গাজা থেকে ইসরায়েলি দখল প্রত্যাহার, আব্রাহাম চুক্তি—প্রতিবারই মনে করা হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য নতুন পথে হাঁটবে। কিন্তু প্রতিবারই অমীমাংসিত ইসরায়েল–ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব আবার ফিরে এসে সবকিছু ভেঙে দিয়েছে।
এই যুদ্ধবিরতিও একই পরিণতির পথে। পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি ম্লান হবে, চুক্তির শর্ত ধীরে ধীরে লঙ্ঘিত হবে, এবং নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হবে, আর একসময় আবার যুদ্ধ বাঁধবে। এ যেন এক অনন্ত নরককুণ্ডের আগুন।
যখন সবাই বারবার সংঘাতে জড়ায়, কাতার ততই শক্তিশালী হয়। মধ্যপ্রাচ্যের অবিরাম যুদ্ধচক্রে প্রকৃত বিজয়ী তারা নয় যারা যুদ্ধ করে, বরং যারা যোদ্ধাদের মধ্যে শান্তির সওদা করে।
প্রতিটি যুদ্ধবিরতি কাতারের অবস্থানকে আরও উঁচু করে, পুনর্গঠনের প্রতিটি উদ্যোগ তাদের হাতে প্রবাহিত করে নতুন সম্পদ, আর প্রতিটি সংকটে পশ্চিমা ও আরব নেতারা দোহার দরজায় কড়া নাড়ে।
এটি ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তোলার কথা—কিন্তু তারা তাতে অনাগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র কাতারকে মধ্যপ্রাচ্যের "অপরিহার্য" মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উঁচুতে তুলেছে, অথচ এই রাষ্ট্রটি অনেকভাবে আমেরিকার মিত্রস্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করছে বলে মনে করা হয়।
মুসলিম ব্রাদারহুড ও হামাসের প্রতি সমর্থন, আল জাজিরার মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করা, ইরান ও উপসাগরীয় মিত্রদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা—সবই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবিরোধী। কিন্তু কাতার সফলভাবে ওয়াশিংটনকে বোঝাতে পেরেছে যে তাকে ছাড়া সমাধান-ও সম্ভব নয়।
এ ফলাফল অবশ্যম্ভাবীই ছিল। অবাস্তব লক্ষ্য নিয়ে শুরু হওয়া যুদ্ধ কখনো সন্তোষজনক পরিণতি দেয় না। যখন প্রকৃত সমাধানের বদলে "সংকট ব্যবস্থাপনা" চলে, তখন শূন্যস্থান পূরণে কাতারের মতো কৌশলী রাষ্ট্রই এগিয়ে আসে।
আকার, সম্পদ বা সামরিক শক্তিতে নয়—কূটনৈতিক চাতুর্যে কাতার আজ আঞ্চলিক প্রভাবের কেন্দ্রে।
তাহলে গাজার যুদ্ধবিরতিতে আসল জয় কার? তাকান দোহার দিকে—যেখানে হামাস নেতারা নিরাপদে বসবাস করছেন, যেখানে গাজা নিয়ে আঞ্চলিক সম্মেলন হচ্ছে, আর দেশটির আমির ও প্রধানমন্ত্রী শান্ত হেসে দেখছেন, কিভাবে বিশ্ব তাদের দরজায় ভিড় জমাচ্ছে।
বাকি সবাই যেন দাবার গুটির মতো একই বোর্ডে ঘুরছে। কিন্তু কাতার খেলছে দাবা—আর তারা ইতিমধ্যে কয়েক চাল এগিয়ে।
লেখক: লিওন হাদার একজন পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ও স্যান্ডস্টর্ম: পলিসি ফেইলিওর ইন দ্য মিডল ইস্ট গ্রন্থের লেখক। এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত তার মূল নিবন্ধ থেকে পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত আকারে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকের জন্য এটি অনূদিত করা হলো।
